“প্রাইভেট কোম্পানিগুলো মাইনে দেয় ভালোই, কিন্ত গাধার মত খাটায় দিন-রাত বুঝে ওঠার সময় পাওয়া যায় না। টাকা রোজগার হয় ঠিকই – ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সও হয় মানানসই, কিন্ত খরচ করার সময় নেই – সেই Monotonous Life.”
ট্রেনের দরজার ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুরফুরে হাওয়া খেতে খেতে অরুণ এইসব কথা মনে মনে ভেবে চলেছিল। কাঁধে একটা দামী চামড়ার ব্যাগ। একটা কোম্পানির ম্যানেজার সে। অনেকদিন ধরেই রেবা, তার স্ত্রী আবদার করে আসছিল একসাথে কোলকাতা ঘুরে আসার কথা। ইছছা তারও ছিল, কিন্ত কাজের চাপে তা চাপা পড়ে যাচ্ছিল। ফলে আবদার যখন দাবীতে পরিণত হল, গৃহ আন্দোলনের উপক্রম – অবস্থার সামাল দিতে অরুণকে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে বেরোতে হল।
ট্রেন খড়দহ এলে অরুণ নেমে পড়ল। দেখল দূরে রেবা তার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। একটা মিষ্টি হাসি চোখে পড়ল – যুদ্ধজয়ের কিনা বোঝা মুশকিল।
- কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছ?
- বেশিক্ষণ নয়। টিকিট কেটে রেখেছি, যেমনটা বলেছিলে।
- ঠিক আছে। পরের নৈহাটি লোকালে শিয়ালদা যাব।
নৈহাটী লোকালটা ফাঁকাই ছিল। দুজনে জানলার ধারে বসার জায়গাও পেয়ে গেল বেশ। ওপরের বাঙ্কার ফাঁকা পেয়ে অরুণ কাঁধের ব্যাগটা সেখানে রেখে দিল। তারপর সংসারের নানা কথায় তারা মশগুল হয়ে পড়ল। খনিকের মধ্যে তারা জগতের অন্য সকল সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। কোন স্টেশন যাচ্ছে, কোন লোক উঠছে বা নামছে, তার দিকে খেয়ালও রইল না। সচরাচর তাদের মধ্যে সময়ই মেলে না এত কথা বলার। তাই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে কে না চায়।
শিয়ালদায় নেমে তাদের গন্তব্যস্থল ছিল এণ্টালির এক ট্রাভেল এজেন্সিতে ভ্রমণ বিষয়ক কিছু খোঁজ খবর নেওয়া। প্রয়োজনে হোটেল বুকিং, ট্রেন বুকিং করা। একঘেয়েমি জীবন থেকে change চাইছিল দুজনে।
বাস থেকে নেমে রেবার হঠাত খেয়াল পড়ল অরুণের কাঁধের ব্যাগটা উধাও – নেই।
- তোমার ব্যাগটা কোথায়? আঁতকে উঠল রেবা।
এতক্ষণে অরুণের সম্বিত ফিরল। কাঁধটা অনেক্ষণ ধরেই হাল্কা লাগছিল। তবে কি পকেটমারি হয়ে গেল?
- বাসে ওঠার সময় কি ব্যাগটা ছিল? সন্দেহ নিরসনের জন্য গম্ভীর ভাবে প্রশ্ন করল।
- না মনে হয়।
- তা হলে ট্রেনে ফেলে এসেছি। ভাবলেশহীন ভাবে অরুণ উত্তর দিল।
- এখন কি হবে?
- কি আর হবে! চল, আগে কাজ মেটাই। তারপর স্টেশন মাষ্টারের কাছে যেতে হবে।
- তুমি কি ভাবছ ব্যাগ আর ফেরত পাবে?
- নিশ্চয়ই।
অরুণের এই নির্লিপ্ত মনোভাব রেবার একেবারেই মনঃপুত হল না। আশ্চর্য লোক একটা। নিদেনপক্ষে সে যেভাবে আঁতকে উঠেছিল, সেইরকম ভাব প্রকাশ করলে তবুও মানা যেত। কিন্ত তা না। কোন তাপ-উত্তাপ নেই – যেন কিছুই হয় নি।
- ব্যাগ হারানোর পর তোমার যা reaction দেখলাম, নিজের বৌ হারালেও তো এইরকম নির্লিপ্ত থাকবে। রাগে গজগজ করতে করতে রেবা বলল।
“To err is human – ভুল মানুষ মাত্রেই হয়”- এই ভাবনায় নিজের ভাবনাকে চালিত করে অরুণ নিজেকে রেবার খোঁচা থেকে সামাল দিল। মনোগত সামান্য পরিবর্তন হলেও বাইরে তার প্রভাব দেখা গেল না। অরুণকে চুপ থাকতে দেখে রেবা আরো খেপে গেল। এমনসময় ননদের ফোনটা এল। শারীরিক কুশলাতা জানতেই নিছক ফোনটা। রাগে মাথাটা এতই গরম ছিল, সমস্ত ঘটনা এবং অরুণের নির্লিপ্তভাব গলগল করে উগরে দিল। জ্বালা খানিকটা মিটল।
২
দিদির বিয়ে সামনের সপ্তাহে, মাথায় অনেক চাপ। জিনিসপত্র কেনাকাটার উদ্দেশ্যে রাতুল ডানকুনি থেকে ডানকুনি-শিয়ালদা লোকালে উঠল।ট্রেনটি ফাঁকা, দুই একজন গোনাগুন্তি লোক ট্রেনটিতে। জানলার ধারে এক কোণে সে বসল। তার সীটের আশেপাশে কেউ নেই।চিন্তার স্রোত মাথার মধ্যে এতই চেপে বসেছিল যে ট্রেন কখন ছাড়ল তা সে খেয়াল করতে পারল না। খেয়াল পড়ল তখনই, একটা স্টেশন অতিক্রম করার পর দূরের বাঙ্কারে যখন তার নজর পড়ল। একটা কালো চামড়ার ব্যাগ চিত হয়ে শুয়ে আছে। কেউ যেন ব্যাগটা ইচ্ছা করে রেখে চলে গেছে বলে মনে হল। যখন সে উঠেছিল তখন থেকেই সে দেখেছিল, এখনো পর্যন্ত ব্যাগটার দাবীদার কাউকে দেখতে পেল না। নিজের অনুমান সুনিশ্চিত করতে আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করল যে ব্যাগটা তাদের কারো কিনা, সবাই জানাল ব্যাগটা তাদের কারো নয়।
চিন্তাস্রোতে ছেদ পড়ল রাতুলের। ট্রেন কামরায় সকলের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। রাতুলের চিন্তা এবং অন্য সকলের চিন্তার গতি এক দিকেই বইতে লাগল। ব্যাগটায় বিস্ফোরক পদার্থ নেই তো? সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগটি যে পাশের বাঙ্কারে রাখা ছিল সেইপাশের সিটগুলো থেকে লোকজন হুড়োহুড়ি করে সরে গেল। নিমেষের মধ্যে সিট ফাঁকা হয়ে গেল। পরবর্তী স্টেশনে লোকজন নামল এবং উঠলও। সিট খালি দেখে দুই একজন দৌড়ে বসতে গেল।
- যাবেন না দাদা, বসবেন না। সমস্বরে অনেকে চেঁচিয়ে উঠল।
- কেন? কেউ বমি টমি করেছে নাকি? নবাগতের প্রশ্ন।
- না।
- তবে? বেশ দেখছি পরিষ্কার। বসব না কেন?
- দাদা ওপরের বাঙ্কারে একটা ব্যাগ রাখা আছে। কেউ দাবিদার নেই। মনে হচ্ছে বিস্ফোরক রাখা হয়েছে।
- কি সর্বনাশ! পুলিশে খবর দিয়েছেন?
- আচ্ছা দাদা, অত প্রশ্ন করছেন কেন বলুন তো? আমাদের কারো ইচ্ছে নেই যেচে পুলিশের ঝামেলায় পড়তে। আপনার ইচ্ছা থাকলে আপনি দিন না।
এইরকম ঝাঁঝানিময় কথাবার্তা শুনে নবাগতের আঁতে ঘা লাগল। নবাগত ততোধিক গলা চড়ালেন,
- ফালতু বকবেন না। জানেন, আপনাদের মত ক্যালাস লোকগুলোর জন্যই কাসভ নারকীয় কাণ্ড ঘটাতে পেরেছিল।
- মুখ সামলে দাদা। ক্যালাস কাকে বলছেন? সবাই কি আপনার চাকর?
ট্রেন কামরায় প্রাত্যাহিক ঝগড়ার সূত্রপাত ঘটল। বাদী, বিবাদী দুই পক্ষ সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নিল। ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিতের বোঝাপড়ায় ট্রেনের কামরা গমগম করতে লাগল। ট্রেন দমদমের দিকে এগিয়ে চলল।
রাতুল ট্রেনের মধ্যে উদ্ভুত পরিস্থিতে বেশ ঘাবড়ে গেল। মনে মনে ভাবল – “আপনি বাঁচলে বাপের নাম। পরের ট্রেনে শিয়ালদা পৌঁছালে এমনকিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।”রাতুল পরের স্টেশনে নেমে পড়ল।
৩
কাজ সেরে অরুণ ও রেবার গন্তব্যস্থল হল শিয়ালদহ স্টেশনমাস্টারের ঘর। দুজনের মুখেই কোন কথা নেই। অরুণ স্টেশনমাস্টারের সঙ্গে সব কথা খুলে বলতে খোঁজ নিয়ে তিনি জানালেন নৈহাটী লোকালটা শিয়ালদা ছেড়ে বারাসাত গেছে। এখন ডাউন বারাসাত মিনিট পনেরর মধ্যেই শিয়ালদা ঢুকবে।
- উফ, আমার পা-টা ব্যাথা হয়ে গেল। কিন্ত তোমার হতচ্ছাড়া বারাসাত লোকালের এখনো দেখা মিলল না। রাগে গজগজ করতে করতে রেবা মৌনতা ভাঙল।
অরুণেরও ব্যাপারটা অবাক লাগল। পনের মিনিট ধরে সে কান খাঁড়া করে রেখেছে। কিন্ত বারাসাত লোকালের কোন খবর নেই। অগত্যা আবার স্টেশনমাস্টারের ঘর।
- Oh! Sorry. ওটা বারাসাত –প্রিন্সেপঘাট হয়ে গেছে। ওখান থেকে প্রিন্সেপঘাট-ডানকুনি হয়ে ডানকুনি যাবে।
- আরে, আপনি আমায় wrong information দিলেন কেন? পনের মিনিট আগেই তো আমি দমদম যেতে পারতাম। তাজ্জব অরুণের অনুযোগ।
- দেখুন, আপনার উচিত ছিল Enquiry তে খোঁজ নেওয়া। স্টেশনমাস্টার অরুণের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে খালাস হতে চাইলেন।
- ঠিক আছে। বলছিলাম যে প্রিন্সেপঘাট থেকে ডানকুনি লোকাল দমদম কখন আসবে?
- ও! আপনারা চলে যান। আসার সময় হয়েই এল আরকি। তবে চামড়ার ব্যাগ তো – না পাওয়ার সম্ভবনাই বেশি। যাই হোক, best of luck.
স্টেশনমাস্টারের ঘর থেকে বেরিয়ে সমস্ত ঘটনা রেবাকে জানাতে সব রাগ স্টেশনমাস্টারের উপর গিয়ে পড়ল। স্টেশনমাস্টারের শাপ শাপান্ত করতে করতে রেবা ছুটল অরুণের পিছনে দমদম যাওয়ার জন্য। অফিস টাইম। ভিড় ট্রেনে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে দুজনে দমদম পৌঁছাল এবং সোজা গেল স্টেশনমাস্টারের ঘরে।
- কি ব্যাপার?
ব্যাপারটা অরুণ সবিস্তারে জানাতেই তিনি সময়সূচী দেখে জানালেন,
- ওটা ডানকুনি ছেড়ে এখুনি দমদম ঢুকছে। শিরগির যান।
তড়িঘড়ি করে ছুটল তারা। কানে ভেসে এল দুই নম্বর প্লাটফর্মে ডাউন ডানকুনি লোকালের অ্যানাউন্সমেণ্ট। ধীরে ধীরে ট্রেনটি প্লাটফর্মে ঢুকল।
- রেবা এই তো সেই কামরা। চল উঠি।
- আরে ধুর! এটা সেই কামরা নয়। ওই ট্রেনটা পুরোনো ছিল, আর এটা নতুন।
অরুণ হতাশ হয়ে বসে পড়ল। তবে কি ট্রেনটা তাদের আসার আগে বেরিয়ে গেছে? সব ছোটাছুটি এক মুহুর্তে অর্থহীন হয়ে পড়ল। তার আত্মবিশ্বাস হঠাতই যেন টলে উঠল। অরুণ যতক্ষণ নির্লিপ্ত ছিল, রেবা তার উপর রাগ করে অষ্টবক্র মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্ত যখন অরুণকে ভেঙ্গে পড়তে দেখল, তারও মন খারাপ লাগল- করুণা হল, স্বান্ত্বনার হাত পিঠে রাখল।
হঠাত একটা সোরগোল তাদের চিন্তাভাবনাকে থামিয়ে দিল। দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকাল। চার নম্বর প্লাটফর্মে সবে একটা ডাউন ট্রেন ঢুকেছে।কি ট্রেন সেটা তাদের খেয়াল ছিল না। মনে হয়, গণ্ডগোলটা ঐ ট্রেনটাকে ঘিরেই। অরুণ পাশের চলমান ব্যস্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করল,
- কি হয়েছে দাদা?
- আর বলবেন না। ডাউন ডানকুনি লোকালের এক কামরায় একটা পরিত্যক্ত কালো চামড়ার ব্যাগ পাওয়া গেছে। কে জানে তাতে কি আছে। দিনকাল তো আর ভাল নয়।
একটা অর্থবহ হাসি খেলে গেল অরুণ ও রেবার মুখে।
TheNewOrder, Part 2 – Lebensraum (Living Space)
5 years ago
0 Comments