১ 

খবরটা দাবানলের মত পুণা শহর থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। রিধা শেখ নামে ১৪ বছরের মেয়ে জাহাঙ্গীর হসপিটালে সোয়াইন ফ্লুর প্রথম শিকার। টিভি কাগজে সর্বত্রই সোয়াইন ফ্লুর আলোচনা। অনিল বিশ্বাস পুণেতে চাকরি সূত্রে বছর দেড়েক হল পরিবার নিয়ে ঘাঁটি গেড়েছে। একটি সফটওয়ার কোম্পানির ম্যানেজার রাঙ্কে কাজ করে সে। আগষ্টের শেষ দিকে ছুটি নেবে ভেবেছে কলকাতা যাবে বলে।সবই ঠিকঠাক ছিল, তার মাঝে এই উটকো বিপদ সকলকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সাতটা বাজে। অফিস থেকে ফিরে টিভির খবরের দিকে চোখ রাখতেই নজরে পড়ল পুণেতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ জন। চোখ ফেরাতেই দেখল অনু, তার স্ত্রী সরবত গ্লাস হাতে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। - কিছু বলবে? - আগে আগে কলকাতায় বেরিয়ে পড়লে হয় না? - কেন? - চারিদিকে যা শুরু হয়েছে! আর তোমাকে তো বলার সময় পাইনি, মামনিটার জ্বর জ্বর মত হয়েছে আজ দুপুর থেকে। মাথার মধ্যে একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। একটু ভেবে শান্ত কণ্ঠে বলল, - অত ঘাবড়াবার কিছু নেই। দেখছি কি করা যায়। - এখানে একবার পরীক্ষা করিয়ে নিলে হয় না? - হুম, নিলে হয়। ভাবছি তাড়াতাড়ি কলকাতায় পাড়ি দেব,পরীক্ষাটা ওখানেই করিয়ে নেব। - কোলকাতায়?? - হ্যাঁ, এত আঁতকে ওঠার কি হল? - বাবা গো! ওখানে চিকিৎসার যা হাল! - দেখ, তোমাদের একটা বদ্ধমূল ধারণা চলে এসেছে বাংলার যা কিছু সব বাজে। এটা পাল্টাও। জান, সারা দেশে মৃত্যুর হার ৭.৪ ভাগ আর পশ্চিমবঙ্গে সেটা ৬.৩ ভাগ? - নেট ঘেঁটে তুমি যে ভুরি ভুরি তথ্য উজাড় করে দেবে সে আমার জানা আছে। কিন্ত কোলকাতায় পরীক্ষা করানোতে আমার মন মোটেই সায় দিচ্ছে না। যা ভাল বোঝ কর। তীব্রভাবে মনের বিরক্তি প্রকাশ করে অনু ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অতএব পত্রপাঠ টিকিট কাটা আর কোলকাতার দিকে রওনা। ২ অসীম এসেছে তার বাবা তড়িৎ সমাদ্দারকে দেখতে কল্পতরু নামে এক প্রাইভেট নার্সিং হোমে। সকাল সাড়ে আটটায় ভিজিটিং আওরস। তাড়াতাড়িই এসেছে সে। বাবাকে নিয়ে সে যখন নার্সিং হোমে পরীক্ষা করাতে এসেছিল, তখন বাহারি চাকচিক্যে এই নার্সিং হোম সম্পর্কে আলাদা ধারণা গড়ে উঠেছিল। নানান পরীক্ষা সেদিন করা হয়েছিল। যদিও রিপোর্টে কিছু ধরা পড়েনি। কিন্ত টাকা মেটাতে যখন অসীম মেডিক্লেমের নাম নিল, নার্সিং হোম থেকে বলা হল একদিন অবজারভেসনে রেখে যেতে। সে থেকেই বাবা গত দুদিন হল নার্সিং হোম বন্দী। যতবারই অসীম বাবাকে নিয়ে যাওয়ার প্রসংগে কতৃপক্ষের সাথে কথা বলতে চায় ততবারই নান অজুহাতে, নানা আছিলায় তাকে বাধা দেওয়া হয়। তাই আজ সে ঠিকই করে এসেছে যে কোন মূল্যে সে কথা বলবেই আর বাবকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে। - তড়িৎ সমাদ্দারের বাড়ির লোক কেউ আছেন? - হ্যাঁ আছি। অসীম উঠে দাঁড়ায়। - এইখানে তাড়াতাড়ি সই করুন আর ১০০০০ টাকা অ্যাডভান্স করুন। রিসেপশনিস্ট একটা ফর্ম অসীমের হাতে ধরিয়ে দিল। - কেন? আকাশ থেকে পড়ল অসীম। - আপনার বাবার কন্ডিশন খুব ক্রিটিকাল। আই তি ইউ তে ভর্তি করা হবে আজই। সেই জন্য এই বণ্ড সই করতে এবং অ্যাডভান্স দিতে বলা হচ্ছে। অসীম বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। সে ভেবে পেল না যে কি এমন ঘটল যে বাবাকে আই সি ইউ তে ভর্তি করা হবে। বুকটা তার অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। মাথায় একসাথে অনেক চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল। পাড়ার মোড়ে রতন, পঞ্চা, বিল্টুরা আড্ডা মারছিল। হঠাৎ অসীমকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখে ডাক পাড়ল, - কি রে অসীম, জ্যেঠুর শরীর কেমন? ওদের দেখে অসীম একটু থমকে দাঁড়াল। নিজেকে আর সামলাতে পারল না। সব কথা শুনে সকলের চোখ কপালে চড়ল। একটাই প্রশ্ন সবার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল – কি এমন হল যে আই সি ইউ তে ভর্তি নিয়ে নেবে? - এই মুহুর্তে দশহাজার টাকা কোথায় পাই? - আরে দাঁড়া। টাকার ব্যাপারে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না। সে জোগাড় হয়ে যাবে। তবে এবার নার্সিং হোমে তুই একা যাবি না, আমরা সাথে যাব। রতনের কথা শুনে মনে বল পেল অসীম। সবাই ছুটল নার্সিং হোমে। অসীম রিসেপশনিস্টের কাছে যেতেই একটাই প্রশ্ন কানে বাজল, - টাকা এনেছেন? - আগে আমরা পেশেন্ট দেখতে চাই, ডাক্তারের সাথে কথা বলতে চাই। পাশ থেকে বিল্টু মন্তব্য করল। রিসেপশনিস্ট অবাক চাহনিতে অসীমের দিকে চাইল। সেটা বুঝে পঞ্চা বলল, - আমরা পেশেন্ট পার্টির লোক। দয়া করে পেশেণ্টকে দেখতে দিন। - সেটা সম্ভব নয়। ভিজিটিং আওরস ছাড়া দেখা করানো যায় না। দেরী করলে আপনাদের ক্ষতি। সে ক্ষেত্রে রুগী বাঁচানোর দায় আমাদের উপর বর্তাবে না। - বেশ, তবে ওনাকে যিনি দেখছেন তাঁর সাথে দেখা করান। কিন্ত শত অনুরোধ, যুক্তির জালেও রিসেপশনিস্টকে পরাস্ত করা গেল না। ফলে কথায় কথা বাড়তে লাগল। অনুরোধ ক্রমশ ক্রোধে পরিণত হল। যুক্তি ক্রমশ হুমকিতে রূপ নিল।আচমকা একটা বিশৃঙ্খল পরিবেশের সৃষ্টি হল। এরই মধ্যে সবার অলক্ষ্যে রতন ও বিল্টু উপরে উঠে গেল। ৩ কোলকাতায় এসে বেলেঘাটার আই ডি হাসপাতালে যখন অনিল স্যালাইভা টেস্টের জন্য মামনি আর অনুকে নিয়ে লাইনে দাঁড়াল, তখন চারপাশের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেখে, দীর্ঘ লাইন এবং অব্যবস্থা লক্ষ্য করে অনু তার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসল। হাসির অর্থ বুঝতে অনিলের এক মুহুর্ত দেরী হল না। নিজের বক্তব্যের সমর্থনে সে মনে মনে আরো কতগুলো যুক্তি খাঁড়া করতে লাগল। হতে পারে অপরিষ্কার, কিন্ত কত লক্ষ লক্ষ মানুষকে কম পয়সায় পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছে। সারা দেশের জনগণের ৬০ শতাংশ স্বাস্থ্য পরিষেবা পায় আর পশ্চিমবঙ্গে পায় ৭২ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে এই অব্যবস্থাকে মেনে নিতেই হবে। অবশেষে স্যাম্পেল দিয়ে বাড়ি ফিরল অনিল। কলকাতায় যে এখনো ফ্লু ছড়ায় নি – এটাই স্বস্তি। ৪ মরছি ভুগে আঁধার রাতের যন্ত্রনাতে উঠছি মেতে মনের সাথে মন্ত্রণাতে ভাবছি আদৌ মিলবে ছাড়? কিম্বা টিকিট ভবের পার। বন্দী জীবন – রুদ্ধ দেওয়াল এরই নাম হসপিটাল। মনের বিরক্তিটাকে নিজের খাতায় এইভাবে লিখে ফেললেন তড়িৎ বাবু। আপাতত তিনি এই নার্সিং হোমের তিনতলায় একটি কেবিন বন্দী। কেন যে হঠাৎ তাঁর স্থান এখানে হল তা তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। দুদিন আগে অফিস যাওয়ার সময় খেতে বসে বিষম লাগল। এমন বিষম যে প্রাণ ওষ্ঠাগত। তারপর হোম ফিজিসিয়ান দিয়ে চেক-আপ, বাড়ির লোকের পরামর্শ মত এই নার্সিং হোমে আগমণ। তারপর থেকেই দুদিন ধরে কেবিন বন্দী। রোগের কারণ এখনো অজানা। স্নান সারা হয়ে গেছে তাঁর। শরীর ঝরঝরে হলেও মনের মধ্যে একটা খিঁচ রয়ে গিয়েছে সেই সকাল থেকেই। বাড়ি থেকে তো কেউ এল না। সকালের ভিজিটিং আওরসেই তো আসার কথা। এরই মধ্যে কি সবাই তাঁকে ভুলতে শুরু করল? মনের মধ্যে একটা বিরক্তির উদ্রেক হল। দেখা যাক বিকাল বেলায় কি হয়। মনের বিরক্তিকে চাপা দিতে তিনি খবরের কাগজ হাতে বসলেন। অনেক্ষন হয়ে গেল। এবার কাগজটা ভাঁজ করে বাইরের চেয়ার ছেড়ে সবে উঠবেন ঠিক করেছেন, এমন সময় দুটো পরিচিত মুখের দেখা মিলল। - কেমন আছো জ্যেঠু? তুমি নাকি আই সি ইউ যাবে? রতন মিটি মিটি হেসে প্রশ্ন করল। - আই সি ইউ? অবাক হলেন তড়িৎ বাবু। ইয়ারকি হচ্ছে? লজ্জা করে না? অসীম কোথায়? সে কি সব জায়গায় তোমাদের পাঠিয়ে দিয়ে দ্বায়িত্ব সারছে নাকি? খেপে উঠলেন তিনি। - শরীরে কোন সমস্যা নেই তো? বিল্টু জিজ্ঞাসা করল। - সমস্যা আমার এখানে। চেঁচিয়ে উঠলেন তড়িৎ বাবু। অসীম কি আমায় নার্সিং হোমে বন্দী করে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নাকি? আমি কি আর ছাড়া পাব না? ক্ষোভের পরিমাণ দ্বিগুণ হল। - নিশ্চয়ই পাবে। - কবে পাব? - আজই আর এখনই। নিমেষের মধ্যে রতন আর বিল্টু তাঁকে কাঁধে তুলে নিয়ে নিচে নামতে শুরু করল। এই অদ্ভুদ কাজে তড়িৎ বাবু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। মুখে কোন কথা সরল না। নার্সিং হোমের কয়েকজন বয় বাধা দিতে এল বটে, কিন্ত পেরে উঠল না। রিসেপশনের সামনে যখন তড়িৎ বাবু স্বশরীরে হাজির হলেন, তখন সকলে ভূত দেখার মত চমকে উঠল। নার্সিং হোমের কর্তৃপক্ষের মুখ চুপসে গেল। রিসেপশনিস্ট পালানোর পথ খুঁজতে লাগল। নার্সিং হোম আর নার্সিং হোম রইল না। ভাঙাচোরা সরকারি আবাসনে পরিণত হল। ৫ সায়েন্স সিটি থেকে ফিরে এসে টিভির দিকে রাতের খবরে চোখ পড়ল অনিলের। প্রিয়ঙ্কা বিশ্বাস নামে একটি ১৫ বছরের মেয়ের স্যাম্পেল টেস্টে সোয়াইন ফ্লুর জীবানু ধরা পড়েছে। চমকে উঠল অনিল। মামনি নয়তো! নাম, পদবী, বয়স সবই তো মিলে যাচ্ছে। বাড়ির সকলের মধ্যে চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেল। মেয়ের শরীর খুব একটা খারাপ না হলেও দুর্বল আছে। তবে তেমন কিছু বাড়াবাড়ি নয়। কোলকাতায় এসে দাদুর বাড়ি ওঠার পর থেকে লাফালাফি আর ঝাঁপাঝাঁপিতে অন্তত সেটা বোঝা যায় নি। মনের খচখচানি কাটাতে অনিল বেসরকারি চ্যানেলের এক বন্ধুকে ফোন করল। ও প্রান্ত থেকে খবর এল আই ডি হসপিটালে প্রাপ্ত স্যাম্পেলে একটি মেয়ের সোয়াইন ফ্লুর জীবানু পাওয়া গেছে। মেয়েটির নাম প্রিয়ঙ্কা বিশ্বাস। বিশ্বাস ক্রমশ বদ্ধমূল হতে আরম্ভ করল। অনুর মুখ থমথমে হয়ে উঠল। বাড়ির পরিবেশ ক্রমশ গম্ভীর হয়ে উঠতে লাগল। তবু সন্দেহ নিরসনের জন্য অনিল ফোন তুলল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলার জন্য। - হ্যালো। - হ্যালো, আমি অনিল বিশ্বাস বলছি বেলঘরিয়া থেকে। এইমাত্র খবরে দেখলাম প্রিয়ঙ্কা বিশ্বাস নামে একটি মেয়ের সোয়াইন ফ্লু দরা পড়েছে। খবরটা কি সত্যি? - হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন। সেই পেশেণ্ট আমাদের হাসপাতালে ভর্তি আছেন। - আরে কি যা তা বলছেন? সে তো আমারই মেয়ে। আমার বাড়িতেই আছে। বিস্মিত ও বিরক্ত অনিল বলে উঠল। - ও তাই। তাহলে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে আসুন। দেরী করবেন না। ওপ্রান্তের নির্লিপ্ত উত্তরে অনিল রাগতভাবে সশব্দে রিসিভার নামিয়ে রাখল। বাস্তবিক সে খুব হতাশ বোধ করতে লাগল। কি করবে তা সে ভেবে উঠতে পারল না। - মনে হচ্ছে পুণেতে ফিরে যাওয়াই ভাল। ঘরোয়া আলোচনায় অনিল মন্তব্য করল। - তুমি ঘাবড়াচ্ছ কেন? এখানে তো অনেক প্রাইভেট নার্সিং হোম আছে। সেখানে মেয়েকে ভর্তি করালেই হয়। অনু ভরসা দিল। - অনু ঠিকই বলেছে। তুই ভাল প্রাইভেট নার্সিং হোমে মেয়ের চিকিৎসা করা। বাবা বললেন। - হুম্‌ তা ঠিক। অ্যাপোলোটা ভাল হবে না? তোমার কি মত? - করাতে পারিস। তবে এখন একটা যশোর রোডের কাছে নতুন একটা নার্সিং হোম ভালো নাম করেছে। বেশ ভাল, আর অ্যাপোলো থেকে সস্তা। - তাই? কোন নার্সিং হোম? - কল্পতরু রিসার্চ এন্ড ডায়গনোটিকস সেণ্টার। ..........................................