দূর্নীতিগ্রস্থ পৃথিবীর মানচিত্রে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৮৪ তম। দক্ষিন এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলির বিচারে ভূটান বাদে ভারতে দূর্নীতি অনেক কম। অবশ্য সমস্ত দেশের বিচারে যদিও নিউজিল্যাণ্ড, ডেনমার্ক, সিঙ্গাপুর, সুইডেন আর সুইজারল্যাণ্ডের স্থান অনেক উঁচুতে। এই সকল দেশের প্রাপ্ত দূর্নীতি ক্রমাঙ্ক ৫। অর্থাৎ এই সকল দেশগুলি দূর্নীতিমুক্ত দেশ। প্রতিবেশী রাষ্ট্র চিনের স্থান ৭৯তম। প্রাপ্ত ক্রমাঙ্ক ৩.৬। তবে ভারত ক্রমেই উন্নতির পথে পা রাখছে। ২০০১ সালে ভারতের প্রাপ্ত দূর্নীতি ক্রমাঙ্ক ছিল ২.৭ আর ২০০৯ সালে তা হয়ে দাঁড়ায় ৩.৪। দূর্নীতিতেও নম্বর! ভাবতে বেশ মজা লাগে কমলের।
- আরে সিগন্যালটা দেখে চালা। কি ছাইপাঁশ ভেবে মরছিস?
পাশে বসা মামার ধ্যাতানিতে ঘুম ভাঙল কমলের। চিন্তার জগৎ ছিন্ন করে বাস্তবের মাটিতে নামল সে। সত্যি, সবুজ সিগন্যালটা কখন লাল হয়ে বসে আছে তা সে খেয়াল করে নি। আরেকটু হলেই সার্জেণ্ট কেস দিয়ে বসত। মামার ধমকানিতে এ যাত্রা রক্ষা হল। মামা মানে পাতানো মামা - সত্যশেখর গাঙ্গুলী। কাজের সূত্রে মামা। বিপদে আপদে সবসময় সাথ দেন।
আজ বুধবার। গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে কমলাকান্ত। পাশে বসে আছে মামা সত্য। পিছনের সিটে মাঝে আছেন তার শ্বশুর কালীবাবু - মুখটা ঈষৎ গম্ভীর, বাঁপাশে ওসি অনিরুদ্ধ রায় - গোঁফে ঢাকা মুখ দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই, আর ডানপাশে টাইপিস্ট বকুল বাবু -ওসি সাহেবের পরিচিত।
কমল ভেবে পেল না কেন তাকে এইরকম চিন্তা বারবার চেপে ধরছে। ব্যাপারটা এরকম হয়ে দাঁড়াচ্ছে যত সে চিন্তামুক্ত হতে চাইছে তত তার মাথায় চিন্তার জাল গ্রাস করছে। অথচ সে কোনভাবেই আজকের ঘটনার সাথে নিজেকে জড়াতে চায় নি। তবু অনিচ্ছাস্বত্তেও জড়িয়ে গেল। যেমন জড়িয়ে গেছে তার মামা সত্যশেখর। সেদিনের কথা ভেবে তার আবার হাসি পেয়ে গেল।
সেদিনটা ছিল রোববার। ভোর হতেই সে ফোন করেছিল সত্যমামাকে। ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা সত্যের। রোজই সকালে উঠে তাঁর দৌড়ানো শুরু আর শুতে শুতে রাত একটা। সপ্তাহে একটা বেলামাত্র তাঁর ছুটি। একটা বেলা মানে রোববারের সকাল। সুতরাং যার দরকার সে পরে আবার করবে এই ভেবে সত্য ফোনই ওঠান নি। ভাগ্যিস মোবাইল নম্বরটা কাছে ছিল, তাই কমল ফোন ছেড়ে মোবাইলে রিং করল। না, ফোন এড়ানো সম্ভব হলেও মোবাইলকে এড়ানো সম্ভব নয়। ওপ্রান্ত থেকে একটা বিরক্তি জড়ানো গলা ভেসে এল,
- হ্যালো
- মামা ঘুমাচ্ছিলে নাকি?
জ্বালাতন! সাধের ঘুম কেড়ে নিয়ে আদিখ্যেতা। মামার বিড়বিড় করে আউড়ানো কথা সে বেশ শুনতে পেল। মামা তার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে বললেন,
- ফোন যখন করেছ, দরকার আছে নিশ্চয়ই। ভনিতা না করে বলে ফেল।
- ফোনে বলা যাবে না। তোমার বাড়ি যেতে হবে।
আপদ! যদি ফোনে কথাটা বলাই না যায় তবে ফোন করা কেন? মামা এবারে দারুণ খেপে গেলেন। খেপে গেলেন বটে কিন্ত বাড়ি আসতে মানা করলেন না। হাজার হোক, ভাগনে বলে কথা।
আসলে কমলের মাথায় তখন কিছু কাজ করছিল না। ঘটনাটা সে যখন তার শ্বশুর মশাই কালীবাবুর মুখ থেকে শুনল তখন সে ঠিক ভেবে দিশা পেল না কোন কাজটা তার আগে করা উচিত। গাড়ি পার্টসের ব্যবসা তার। সে জীবনে কোনদিন থানার চৌহদ্দি মাড়ায় নি। কোর্টকাছারি তো দূর অস্ত। মাথায় তখন একজনের নামই বারবার ভেসে আসছিল, সে হল মামা সত্যশেখর। মামা না থাকলে তার আর ওসি অনিরুদ্ধ রায়ের সাথে পরিচয়ও ঘটত না, আর এ যাত্রা রক্ষা পাওয়ার চিন্তাও পড়ে থাকত বিশ বাঁও জলে।
চায়ের কাপ হাতে সত্যমামা কমলের মুখ থেকে আদ্যপান্ত শুনে খানিকটা চুপ মেরে গেছিলেন। মামাকে থম্ মেরে থাকতে দেখে উদ্ভ্রান্ত কমল তখন আরো বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। জিজ্ঞাসা করল,
- মামা কি বুঝছ? কেস কি খুব জটিল?
- না, ভাবছি তুমি যে কেস নিয়ে এসে হাজির হলে তাতে আমার রোববারের কাজের দফারফা। আরো কদিনের কাজ মাটি যাবে তা কে জানে।
তারপর সোফা থেকে এক ঝটকায় উঠে ছেলে সুশান্তকে কাজের ভার দিয়ে কমলকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। থানার ওসির ঘর বন্ধ দেখে সরাসরি ঢুকে পড়লেন মেজবাবুর ঘরে। ট্রান্সপোর্টের ব্যবসায় ওপরতলা থেকে নীচতলা মায় চোর গুণ্ডাদের সাথে যোগাযোগ রাখাটা অত্যন্ত জরুরী। আর জরুরী বলেই মেজোবাবুর টেবিলের সামনে বসা লোকটিকে চিনতে কোন অসুবিধা হল না। এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের ত্রাস কেলে বাপ্পার সাথে চোখাচোখি হতেই সে হেসে জিজ্ঞাসা করল তাঁর কুশল সংবাদ।
কেলে বাপ্পার সাথে সত্যবাবুর হৃদ্যতা দেখে মেজবাবু অসীম ভদ্র বেশ অবাক চোখে তাঁর দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর কেলেবাপ্পাকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। সে চলে গেলে সত্যশেখরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
- চেনেন নাকি?
সামনের টেবিলে রাখা একটা ব্রিফকেসের দিকে নজর গেল সত্যশেখরের। ঘটনাটা বুঝে নিতে বিন্দুমাত্র সময় লাগল না তাঁর। দুয়ে দুয়ে চার হিসাব করে বুঝলেন, কাছেপিঠে কোথাও কোন ডাকাতির কেসের বখরা নিয়ে এসেছিল একটু আগে কেলেবাপ্পা। তাকে চিনে ফেলায় বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন ভদ্রমশাই। কিছুটা অপ্রসন্নও বটে। তাই তাঁকে এই প্রশ্নটা করা। ব্রিফকেশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে জবাব দিলেন,
- হ্যাঁ, কাজের এবং প্রয়োজনের খাতিরে আপনি যতটা চেনেন আমিও ঠিক ততটাই চিনি।
তাঁর চোখের চাহনি, মুচকি হাসিতে ও অব্যক্ত ইঙ্গিতে ভদ্রমশাই বেশ লজ্জা পেয়ে গেলেন। ব্রিফকেস নামিয়ে রাখতে রাখতে আত্মপক্ষ সমর্থনে বললেন,
- আজকাল বাজারের যা হাল তাতে ঠিক উপায়ে সংসার করলে মনের সকল সাধ আর পূরণ করা যায় না। সোনার দাম যে হারে বেড়ে চলেছে তাতে বউয়ের গয়না গড়াতে, মানে, বুঝতেই তো পারছেন, এইসব উপরি পাওনাই ভরসা।
- হ্যাঁ স্যার, বিলক্ষন বুঝেছি। বিব্রত ভদ্রমশাইকে আর বেশি অপ্রস্তুতে না ফেলে সত্যশেখর জিজ্ঞাসা করলেন, তা ওসি সাহেব আসবেন কখন বলতে পারেন?
- আমায় বলুন না, আমি সব সমস্যার সমাধান করে দেব।
নেহাত অনেকদিনের যাতায়াত, অনেক কালের পরিচয়, তাই অকপটে অম্লান বদনে সত্যবাবু বলে উঠলেন,
- থাক্, যা খাওয়ার সে একজনেই খাক্।
তাঁর কথা শুনে ভদ্রমশাই আরো সংকুচিত হয়ে পড়লেন। আর কথা না বাড়িয়ে বাইরে ওসি অনিরুদ্ধ রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে বললেন। খানিকপরেই ওসিসাহেবের সাথে তাঁদের দেখা হল।
আসলে যত কাণ্ডের মূলে হলেন তার একমাত্র শ্বশুর কালী কিঙ্কর রায়। তিনি হলেন বর্ধমানের এক বড় চাল ব্যবসায়ী। অন্যদিকে আবার স্থানীয় চাল ব্যবসায়ী সমিতির প্রেসিডেণ্ট। এলাকায় তাঁর যথেষ্ট নাম- প্রতিপত্তি। তাঁর গুদাম থেকে দশ লরি চাল যাচ্ছিল বাংলাদেশের দিকে। ব্যবসায়ে একটু হাতসাফাই, কিঞ্চিৎ ফাঁকি দোষের মধ্যে ধরেন না কালীবাবু। প্রতিবারের মতোই এবারেও তাই এক গাড়ির লেভিতে দশ গাড়ির মাল পাঠিয়েছিলেন। এর আগেও এ নিয়ে কোন অসুবিধা হয় নি। কিন্ত এবার তা হল না। যশোর রোডের কাছে এক চেকপোষ্টে একগাড়ি মাল ফেঁসে গেল প্রয়োজনীয় লেভি না দেখানোর কারণে। কি করে যে এমনটা হল তা তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারলেন না। হয়তো ড্রাইভার ব্যাটা জায়গামতো খাওয়াতে পারে নি। অগত্যা মাল ছাড়ানোর দ্বায়িত্ব দিলেন তাঁর একমাত্র করিৎকর্মা জামাই কমলাকান্তের উপর। উপায় না দেখে মামাকে সব কথা জানানোর আগেই কমল প্রথমে ছুটেছিল স্থানীয় থানায়। কিন্ত সেখান থেকে তাকে বলে পাঠানো হয় যশোর রোড সংলগ্ন নিকটবর্তী থানায় যেতে। আর সেই কারণেই কমলাকান্ত আর সত্যশেখর এসে হাজির ওসির কাছে।
সব শুনে অনিরুদ্ধ রায় বললেন,
- সবই তো বুঝলাম। কিন্ত কেসটাতো আর আমার হাতে নেই। কোর্টে চালান হয়ে গেছে। মেটাতে কিন্ত মালকড়ি ঢালতে হবে।
মামলা রফা করতে ওসি সাহেব ৬০ হাজার টাকা চেয়ে বসলেন। তারমধ্যে ওসি ৪০ হাজার আর টাইপিস্ট- মামলা জেতানোর চাবিকাঠি যাঁর হাতে, তিনি নেবেন ২০ হাজার। টাইপিস্টকে হাত অবশ্য ওসিই করেছেন। যেহেতু তিনি মামার পরিচিত সে কারণেই এত কমের মধ্যে দিয়ে হয়েছে। নিজের সম্মানের কথা ভেবে শ্বশুরমশাইও নিমরাজি হন নি। মামলাটা আজ কোর্টে উঠবে। গাড়িতে যেতে যেতেই তাই টাকাটা ভাগাভাগি করে নেওয়ার পালা। ব্যাপারটা যেহেতু highly confidential, সে কারণে চালকের আসনে কমলাকান্ত।
অবশেষে যথাসময়ে তারা কোর্টে এসে পৌঁছাল। ম্যাজিস্ট্রেট নির্দিষ্ট সময়ে ঘরে এসে ঢুকলেন। ঘরটা নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল। একটি আল্পিনের শব্দও যেন কানে বাজে। বাঁদিক থেকে পেস্কার মামলার কাগজপত্র তাঁর হাতে এগিয়ে দিলেন।বেশ গম্ভীরমুখে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লেন। তারপর বেশ গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,
- ধরাই বা কেন আর ছাড়াই বা কেন।
তাঁর গলার স্বরে ঘরের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে পড়ল। নিমেষের মধ্যে সবকিছু সইসাবুদ করে তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। বিরক্তি তাঁর চোখেমুখে স্পষ্ট। মামলা মিটে গেল। খালাসি সহ ড্রাইভার ছাড়া পেল।
বাইরে এখন মজলিসের আবহাওয়া। কেস মিটে গেছে। সবাই এখন ফুরফুর মেজাজে। দুই একদিনের ধকলে সবাই কাহিল হয়ে পড়েছিল, এখন তা থেকে নিশ্চিন্তি। কালীবাবু কমলের কানে কানে বলে দিলেন থানা থেকে গাড়ি ছাড়িয়ে আনতে আর ওসিকে খানাপিনার জন্য নেমতন্ন করে আসতে। দুদিন পর সেই মত মামা সত্যকে নিয়ে কমল গেল থানায় অনিরুদ্ধ সাহেবের সাথে দেখা করতে।
কিন্ত অদ্ভুত ব্যাপার। তাঁদের দেখে ওসি সাহেব খুশি হওয়ার বদলে আরও গম্ভীর হয়ে পড়লেন। হাতের ইশারায় বসতে বললেন। তাঁর গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে দুজনেই পরষ্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। অবশেষে সত্য মুখ খুললেন,
- কি ব্যাপার?
- আর বলবেন না। এস পি সুরেন্দর সিং আপনাদের ডেকে পাঠিয়েছেন। কেসটা এত তাড়াতাড়ি কিভাবে মিটল সে ব্যাপারে তিনি সন্দিহান।
তারপর সত্যর দিকে তাকিয়ে আচমকা তাঁর হাতদুটো চেপে ধরে বললেন,
- বেফাঁস কিছু বলবেন না প্লিজ। বউ বাচ্চা নিয়ে মারা পড়ে যাব একেবারে।
কমল ও সত্য দুজনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। দুজনের চোখের সামনে অনেকগুলো গান্ধী নোট ভাসতে লাগল।
..........................................
0 Comments