১

 “...ভারতবর্ষের যে এক তৃতীয়াংশ মানুষ রোজ রাতে ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে ঘুমাতে যায়, যাদের গোটা জীবনটাই কাটে নিরবিচ্ছিন্ন অনটনের মধ্যে আধপেটা খেয়ে, তাদের জন্য ত্রাণের কোন ব্যবস্থা নেই। যে ক্ষুধা হঠাৎ বা চরম নয় কিন্ত সমাজব্যবস্থার মজ্জাগত, তার নীরব উপস্থিতি সংবাদপত্রে আলোড়ন তোলে না, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিক্ষোভ হয় না, ভারতীয় সংসদ তার সম্পর্কে উত্তাল হয়ে ওঠে না। সমাজব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে তা চলতে থাকে।”............... 

 অমর্ত্য সেনের লেখা জীবনযাত্রা ও অর্থনীতি বইয়ের পাতায় বেশ গভীর মনোনিবেশ করেছিল অরিন্দম। অরিন্দম শীল, এই কোম্পানির একজন shift officer। কোম্পানিতে নয় নয় করেও সাত-আটশ জন কাজ করে। বাজারে কোম্পানির বেশ নাম আছে। অতি প্রাচীন কোম্পানি গুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। আজ শনিবার, দুই- দশ ডিউটি। সপ্তাহের শেষ দিন হওয়ার কারণে এমনিতেই সন্ধার পর থেকে সব মহারথীরা ঘর যেতে ব্যস্ত থাকে, তার উপর মালের জোগান ঠিক না থাকার কারণে চারিদিকে ছাড়া ছাড়া ভাব। অবসর সময় যাপনে বই সঙ্গী। হঠাৎ টেবিলের উপর রাখা মোবাইলটা বেজে উঠল। আচমকা আওয়াজে বইয়ের প্রতি মনোযোগ ছিন্ন হল।
 - ‘হ্যালো।’ 
- ‘হ্যালো, আমি সুবোধ স্যান্যালের মেয়ে বলছি।বলছি কি, বাবা কি অফিসে এসেছেন?’
 - ‘দাঁড়াও দেখছি।’ 
 অরিন্দম চট করে ঘড়ির দিকে তাকালো। আটটা বাজে। হিসাবমত টিফিন শেষ, স্যান্যালদার কাজে লাগার কথা। আর স্যান্যালদার মত দায়িত্ববান লোক সময়ের অযথা অপচয় করবেন না এটা বলা বাহুল্য। কিন্ত মেশিনে এসে স্যান্যালদাকে না দেখতে পেয়ে অরিন্দম তাজ্জব বনে গেল। - ‘না তো! এখনো এসে পৌঁছান নি।’ উত্তর দেওয়ার সাথে সাথে ও প্রান্তের ব্যক্তিটি বেশ ভেঙে পড়েছে তা অনুভব করতে পারল অরিন্দম।
 - ‘বাবা সন্ধ্যায় টিফিন খেতে বাড়ি এসেছিল। আমি বলেছিলাম এমাসের টিউশন ফি টা দিতে হবে। বাবা হঠাৎ খেপে উঠে রুটির থালা ছুড়ে ফেলে দিয়ে সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, এখনো তার কোন খোঁজখবর নেই।’ কান্না জড়ানো গলায় মেয়ে বলে উঠল। 
- ‘হুম্‌। দ্যাখো, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ফোন করে। একটু রাত অবধি অপেক্ষা করো। না ফিরলে আমায় ফোন কোরো, দেখছি কি করা যায়।’ চিন্তাগ্রস্ত অরিন্দম প্রত্যুত্তর দিল। 

 স্যান্যালদা একজন শান্তশিষ্ট ভদ্রলোক। কাজের দিক থেকে দেখতে গেলে তিনি অতি দায়িত্ববান এবং পরিশ্রমী। সময়ের যথেষ্ঠ মর্যাদা দেন এবং এক গুরুত্বপূর্ণ মেশিনের অপারেটর। কারো সঙ্গে বাজে বক্‌ বক্‌ করেন না। এ হেন লোক হঠাৎ উধাও হয়ে যাবে তা অরিন্দম মানতে পারছিল না। মাথায় একরাশ চিন্তা নিয়ে অরিন্দম যখন স্টেশনে এল, তখন বাজে রাত দশটা। প্ল্যাটফর্ম শুনশান। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল অরিন্দম। হঠাৎ চোখ গেল প্ল্যাটফর্মের কোণায় এক বেঞ্চিতে। একটি লোক অন্যমনস্কভাবে গভীর চিন্তায় মগ্ন। প্রথমে অত গা করেনি, তারপর অফিসের ড্রেস দেখে ভাল করে ঠাহর হতে অরিন্দম বুঝল এ লোক তার অফিসের নিরুদ্দিষ্ট স্যান্যালদা ভিন্ন অন্য কেউ নন। কাছে গিয়ে পাশে দাঁড়াতেই স্যান্যালদা যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন। তারপর লজ্জিত স্বরে বললেন, 

 - ‘মাপ কবেন সাহেব, টিফিনের পর আর যেতে পারি নি।’
 - ‘সে ঠিক আছে, কিন্ত কি ব্যাপার, বাড়ি থেকে আপনার খোঁজাখুঁজি করছে তো।’ স্যান্যালদা নিরুত্তর থাকলেন। অরিন্দম লক্ষ্য করল চোখের কোণে জল চিক্‌ চিক্‌ করছে। কথা না বাড়িয়ে বলে উঠল,
 - ‘চলুন স্যান্যালদা, ঘরে পৌঁছে দিই আপনাকে, আজ আর কিছু বলার দরকার নেই। ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করুন।’

 পরদিন shift এর কাজ শুরু হওয়ার আগে প্রাত্যাহিক দিনের মত মেশিনের ধারে অপারেটর আর হেল্পারদের জটলায় স্যান্যালদা মধ্যমণি হয়ে গেলেন। অরিন্দম আসতেই স্যান্যালদা বলে উঠলেন,
 - ‘কালকের ঘটনার জন্য আমি সত্যি লজ্জিত সাহেব।’
 - ‘সে ঠিক আছে।’ অরিন্দম এসে জটলায় যোগ দল প্রতিদিনের মতোই।
 - ‘কিন্ত কালকে মেয়ের উপর খামোকা চটে গেলে কেন?’ বহুদিনের সঙ্গী অমলদা প্রশ্ন করলেন।
 - ‘ঠিক মেয়ের উপর নয়। আসলে নিজের উপর বিরিক্ত হয়ে উঠেছিলাম।’ 
- ‘কেন?’
 - ‘আরে ভাই বোঝই তো। যা মাইনে পাই তাতে আর সংসার টানা দায় হয়ে পড়েছে। পুজো আসতে আর মাত্র পনের দিন বাকি। এখনো পুজোর কেনাকাটা কিছুই হয় নি। বোনাস যে কবে পাবো তারও ঠিক নেই। এর উপরে আছে আবার 10% এর খোঁচা। সারা মাস উদয়াস্ত পরিশ্রম করার পরেও যদি অভাবের নিষ্কৃতি না মেলে তো কার ভাল লাগে বল?’ 

 স্যান্যালদার কথার মধ্যে ‘10% এর খোঁচা’ কথাটা তীরের ফলার মত বুকে বিঁধল। সারা বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। সেই মন্দার মোকাবিলায় প্রাইভেট কোম্পানিগুলো নানা ফন্দিফিকির বার করেছে। কেউ কর্মী ছাঁটাই করেছে, কেউ কিছুদিনের জন্য উৎপাদন বন্ধ রেখেছে- এই সব। অরিন্দমের কোম্পানিও বাদ সাধেনি। মন্দার গল্পকে কাজে লাগিয়ে মজাদার ঘোষনা জারি করেছে- 

 “চারিদিকে অর্থনৈতিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে কোম্পানিকে নানা সমস্যার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সেই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ব্যাঙ্কের লোনের প্রয়োজন।আমরা কর্মী সঙ্কোচনের পক্ষে নই। তাই ঘোষনা করছি আগামী পাঁচ বছর অবধি কোম্পানির সর্বোচ্চ পদ থেকে নিচু পদ পর্যন্ত্য সকল অফিসার ও শ্রমিকের বেতন থেকে 10% কাটা হবে।” 

 অরিন্দম সহ সকল অফিসাদের বেতন থেকে সেই অর্থ কাটা হলেও ইউনিয়নের বিরোধিতায় শ্রমিকদের উপর এখনো তার প্রকোপ পড়তে বাকি। 

- ‘ঠিকই, বুঝলে স্যান্যালদা, বাজারে গেলাম তো জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। চাল 19/ থেকে 22/ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। মাছের কথাতো বাদই দিলাম। খাবারের পাতে প্রধান পদ যে আলু তাও ধরাছোঁয়ার বাইরে। বল খাব কি?’ শংকরের কথায় সম্বিত ফিরল অরিন্দমের।
 - ‘10% তো আমাদেরও কাটছে ।’ অরিন্দম শংকরকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল।
- ‘কিন্ত সেটা আবার increment দিয়ে পুষিয়ে দেবে।’ বক্তব্যে ক্ষোভ স্পষ্ট।
 - ‘আরে, আপনাদের কাটবেন না দেখবেন। শ্রমিক ইউনিয়নগুলো তো এর বিরুদ্ধে সরব হয়েই আছে।’ অরিন্দম স্বান্ত্বনার বাণীতে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল। 
- ‘আরে, রাখেন আপনার শ্রমিক ইউনিয়ন। সবকটাই একেকটা ম্যানেজমেন্টের দালাল। সামনেই কো-অপারেটিভ ভোট, তাই সব চেপে আছে। সেটা হলেই ম্যানেজমেণ্টের নোটিশ প্রকাশ্যে চলে আসবে।’ উত্তেজিত অমলদা অকাট্য যুক্তি দিলেন। 
- ‘রাজ্য সরকার বলুন, কেন্দ্রীয় সরকার বলুন, সকলের মাইনে বাড়ছে। আর আমাদের মাইনে সেই মান্ধাতা আমলে যা ছিল তাই আছে। বাজারে গেলে তো দাম সকলের জন্য সমান। কম মাইনে পাই বলে তো ছাড় দেবে না।’

 স্যান্যালদার বক্তব্যের করুণ রস অরিন্দমকে ব্যথিত করল। বাজারে কৃত্রিম সংকটের চাপে পড়ে এক শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, পণ্যসামগ্রীর উপর অধিকার ক্রমশ কিভাবে লোপ পাচ্ছে অরিন্দম মর্মে মর্মে উপলব্ধি করল। মানুষ কিভাবে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ছে তা বুঝল। আরো বুঝল এই অভাবকে আঁকড়ে ধরে কিভাবে রাজনৈতিক বিভিন্ন মতালম্বীর নেতারা সমাজে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। - ‘আমাদের পেটে টান পড়লে আমরাও কি ছেড়ে কথা বলব ভেবেছেন? এর জবাব নিশ্চয় দেব। কাউকে ছাড়ব না।’ স্যান্যালদার চোখ যেন হঠাৎ দপ্‌ করে জ্বলে উঠল। 

                                                               ২ 

 শরৎ কাল। চারিদিকে ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। হাওয়ার তালে তালে মাঠের কাশফুলগুলো মাথা নাড়া দিয়ে জানান দিচ্ছে পুজো আসন্ন। মারুতি সুজুকি গাড়িতে বসে চারপাশের সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে মিঃ সোম বেশ আনমনা হয়ে পড়েছিলেন। মিঃ সোম এই কোম্পানির ডাইরেক্টর। কলকাতার হেড অফিস থেকে তিনি চলেছেন site এ workshop visit করতে। গেটের কাছে এসে গাড়ির হর্নের একটা কর্কশ শব্দে তিনি যেন বাস্তবে ফিরে এলেন। মনে মনে একটু বিরক্ত হলেন। হঠাৎ চোখে পড়ল কয়েকটি পোস্টার গেটে সাঁটা। তাতে লেখা আছে –‘20% বোনাস দিতেই হবে।’ কোনটাতে লেখা আছে–‘20% বোনাসের দাবীতে সকল মজদুর এক হও।’ এরকম আরো অনেককিছু। 
 -‘Disgusting!’ মনের বিরক্তি আর চাপতে পারলেন না।
 ‘শালাদের এত পেয়েও আশ মেটে না। কাজ না করেও চাহিদা ষোল আনা।’

 শরতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য নিমেষে উধাও হল। নিজের চেম্বারে ঢোকামাত্রই তিনি তিনটি ইউনিয়নের নেতাদের তলব করলেন। সংগে নিলেন প্রেসিডেণ্ট মিঃ ভট্টাচার্য আর পার্সোনেল হেড মিঃ রায়কে। ভাবতেই পারছেন না কি করে এই ক্ষোভ প্রকাশ পেল। 
 -‘কি ব্যাপার? বাইরে এসব কি দেখলাম?’ 

 তিন ইউনিয়নের নেতারা নিরুত্তর। তাদের চুপ থাকতে দেখে মিঃ সোমের বিরক্তি আরো বেড়ে গেল। তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, 

 - ‘আপনারা তো জানেন, ব্যাঙ্কের লোন দিয়ে কোনক্রমে কোম্পানিকে চালানো হচ্ছে। তার উপর পুজোতে বোনাস দেওয়া হবে না তা নয়। তাহলে নতুন করে এসব কেন?’ 
- ‘সাহেব এই আন্দোলনের পিছনে আমাদের তিন ইউনিয়নের কারো হাত নেই।’ বামপন্থী দলের তরুণ মুখ খুললেন। মিঃ সোম এবার মিঃ ভট্টাচার্যের দিকে দৃষ্টি রাখলেন।
 - ‘আসলে এখানে নতুন একটা ইউনিয়ন গড়ে ওঠার চেষ্টা চলছে। কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ তিনটি ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এসে এই নতুন ইউনিয়নে যোগ দিয়েছে। তারাই এইসব দাবীদাওয়া শুরু করেছে।’ 
মিঃ ভট্টাচার্য ব্যাখ্যা দিলেন। 
- ‘তাছাড়া সাহেব, সাধারণ শ্রমিকদের ক্ষোভও এর সংগে যুক্ত আছে। সেই ক্ষোভকে এরা হাতিয়ার করছে। আমাদের কথা কেউ কানে নিতে চাইছে না।’ ডানপন্থী দলের সেক্রেটারী বিপুল বললেন।
 - ‘কিন্ত ক্ষোভটা কি নিয়ে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কোম্পানির দুঃসময়ে যা আবদার করব তাই পাব-এটা ভাবলে চলে না।’ মিঃ সোম রাগত স্বরে বললেন। 
- ‘আসলে গত বছর 20% বোনাসের কথা উঠতেই বলা হয়েছিল সামনের বছর দেওয়া হবে। তারপর দীর্ঘদিন যাবৎ Production Bonus এর কোন পরিবর্তন হয় নি। মান্ধাতা আমলের D.A প্রতি ইউনিট 5/- তাই আছে। এসব কারণেই মজদুরদের ক্ষোভ। আমার মনে হয় তাদের দাবী মিটিয়ে দেওয়া উচিত।’ তৃতীয় ইউনিয়নের সেক্রেটারী অনন্ত মাঝি বললেন।
 - ‘খেপেছেন নাকি? এই মন্দার বাজারে কোম্পানি তার অস্তিত্ব রক্ষা করা নিয়ে চিন্তিত। এই অবস্থায় এইসব দাবীদাওয়া মেটানো সম্ভব নাকি?’ মিঃ রায় আপত্তি তুললেন। 
- ‘তবে সাহেব এই মন্দার বাজারে কিছু মুষ্টিমেয় অফিসারদের Reward এর নামে লক্ষাধিক টাকা পাইয়ে দেওয়া হল কেন? সেই টাকাতেই তো সবার এবছর বোনাস হয়ে যেত। শোনা যাচ্ছে সকল অফিসারদের আবার increment হবে।’ অনন্ত চেপে ধরলেন। 
- ‘দেখুন , এখানকার অফিসারদের বেতন অনেক কম। আমরা অনেক অলোচনার মধ্য দিয়ে তাদের বেতনকে একটা নির্দিষ্ট মানে ওঠানোর চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতে এই প্রক্রিয়া জারী থাকবে। এ নিয়ে প্রশ্ন করা বা অন্য কিছুর সাথে তুলনা করা অবান্তর, অবাস্তব।’ মিঃ ভট্টাচার্য অনন্তকে বাধা দিলেন।
 - ‘আপনাদের শ্রমিক বন্ধুদের বলুন Production বাড়াতে। তবেই Production Bonus বাড়বে। খলি দাবীদাওয়া করলেই কোনকিছু পাওয়া যায় না। এইসব আন্দোলন বন্ধ করে পুজোর বোনাসের টাকা তুলে নিতে বলুন।’ মিঃ রায় বললেন। 
- ‘পুরোনো দিনের লঝঝরে মেশিন দিয়ে কি করে বেশি Production আশা করেন সাহেব? নতুন মেশিন আনলে না হয় কথা ছিল।’ 
- ‘আমি কোন কথা শুনতে চাই না। এই জন্যই কি আপনাদের ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধার প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হয়? যা করতে হয়, তাই করুন। যে করেই হোক আন্দোলন বন্ধ করুন।’ মিঃ সোম এই বলে মিটিং শেষ করলেন। তিনটি ইউনিয়নের নেতারা মাথা নিচু করে চলে গেলেন। 

                                                                      ৩ 

ফ্যাক্টারিতে একটা চাপা ক্ষোভের চোরাস্রোত বইতে আরম্ভ করেছে। মিটিং এর ফলাফল যে অন্তঃসারশূন্য তা বুঝতে কারোরই আর বাকি নেই। মজার কথা এই, যে সকল নেতারা মিটিং এ উপস্থিত ছিলেন, বাইরে এসে তাঁরা অদ্ভুদভাবে নীরব। কোন প্রশ্নের সদুত্তর দিতে অপারগ। পুজো আসতে আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। অথচ বোনাস চাওয়া বা পাওয়ার কোন রাস্তা আর নেই। প্রত্যেকেই নিজ সিদ্ধান্তে অটল। সেদিনের মত আজও অরিন্দম সকালে কাজে এসেছে। সকলেই তার নির্দেশ মত কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ সকাল দশটার সময় একজন শ্রমিক তার Department এ খবর দিল প্রেসিডেণ্ট ঢুকে গেছেন ফ্যাক্টারিতে। মুহুর্তের মধ্যে পরিস্থিতি আচমকা পাল্টে গেল। সকলে মেশিন বন্ধ করল চটপট। যেন যুদ্ধের দামামা বেজেছে। চারিদিক শুনশান করে সবাই একসাথে বেরিয়ে গেল। উদ্ভুত পরিস্থিতির জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না অরিন্দম। ঘটনাটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল, তাতে সে হতবাক হয়ে পড়ল। 
 -‘ কি ব্যাপার অমলদা, মেশিন বন্ধ করে সব কোথায় ছুটল?’ পরিস্থিতিকে বোঝার চেষ্টা করল সে।
 - ‘আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব সাহেব। নেতাদের অনেক দেখা হয়ে গেছে। এবার আমরা আমাদের দাবী নিজেরাই বুঝে নেব।’ 

 অরিন্দমও তাদের পিছন পিছন কিছুদূর এগিয়ে কিছু অফিসারদের একসাথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাদের সাথে ভিড়ে গেল। দেখল অনেক শ্রমিক এককাট্টা হয়ে প্রেসিডেণ্টের অফিসে সামনের মাঠে জমায়েত হতে চলেছে। তাদের রাজনৈতিক রঙ নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর। বিভিন্ন দল নির্বিশেষে মানুষ জমায়েত হয়েছে তার প্রাপ্য ছিনিয়ে নিতে। জমায়েতের মধ্যে একদল ছুটল ওপরে প্রেসিডেণ্টের ঘরে। মিঃ ভট্টাচার্য তখন নিজের ঘরে ব্যস্ত ছিলেন ল্যাপ্টপ হাতে। ঘরের দরজা বন্ধ থাকার কারণে তিনি বাইরের পরিস্থিতি আঁচ করতে পারেন নি। মুহুর্তের মধ্যে যখন জনা দশেক লোক হুড়মুড় করে তাঁর ঘরে ঢুকে পড়ল তখন তিনি বেশ ঘাবড়ে গেলেন। 
- ‘কি ব্যাপার? এত লোক একসাথে?’ তটস্থ গলায় প্রশ্ন করলেন।
 - ‘সাহেব, পুজো তো চলেই এল। আমরা কি বোনাস পাব না নাকি?’
 - ‘পাবেন না কেন? ক্যাশ কাউণ্টার তো খোলাই আছে। তুলে নিন।’
 - ‘সে তো 8.33% । আমাদের দাবী 20%।’ 
- ‘তার সিদ্ধান্ত তো আমি একা হাতে নিতে পারি না। সময়ের প্রয়োজন।’ উন্মত্ত শ্রমিকদের শান্ত করতে তিনি একথা বললেন। কিন্ত তাঁর কথাতে শ্রমিক মধ্যে স্ফুলিঙ্গ ফুটে উঠল।
 - ‘সময়! শালা মিটিং করে সময় চেয়ে পুজো পার করে বোনাস দিবি?’ - ‘আমাদের তুই অনেক ফাঁকি দিয়েছিস। অনেক টাকা নিজের পকেটে ভরেছিস। আর নয়। আমাদের প্রাপ্য ভালোয় ভালোয় দিয়ে দে।’ 

 চিৎকার, বাগবিতণ্ডায় অফিসঘরটিতে প্রলয় নাচন শুরু হল। কেউ তাঁর ঘরের দরজায় লাথি মারল, কেউ টেবিল চাপড়ালো, কেউ দেওয়ালে টাঙানো ছবি আছড়ে ভাঙল। অবস্থার দ্রুত অবনতিতে মিঃ ভট্টাচার্য মনে মনে প্রাণভয়ে রাম নাম জপতে শুরু করলেন। গণ্ডগোলের খবর পেয়ে মিঃ রায় তৎক্ষণাৎ সিকিউরিটি নিয়ে অফিস ঘরে আসতে উদ্যত হলেন। কিন্ত নিচের জমায়েত হওয়া শ্রমিকদের ঠেলে মাত্র দুইজন সিকিউরিটি নিয়ে উপরে যখন এলেন, তখন ঘটনাটা দূর থেকে দেখা ছাড়া আর করণীয় কিছু ছিল না। কারণ উন্মত্ত শ্রমিকদের বাধা দেওয়ার অর্থ অনর্থ ঘটানো। 

 শ্রমিকরা এই হুমকি দিয়ে ঘর ছাড়ল যে আজকের মধ্যেই তাঁকে সঠিক সিধান্ত গ্রহন করতে হবে। যতক্ষণ না পর্যন্ত্য তিনি তা না করছেন শ্রমিকরা তাঁকে নিষ্কৃতি দেবে না। ঘরের ছন্নছাড়া অবস্থার দিকে তাকিয়ে ভট্টাচার্য সাহেব হতভম্ব হয়ে পড়ে রইলেন খানিকক্ষণ। মনে করতে চেষ্টা করলেন জীবনে কোন সময়ে এই রকম অপদস্থ হয়েছিলেন কিনা। মিঃ রায় মাটিতে পড়ে থাকা চেয়ার সোজা করে বসলেন। 
 - ‘পুলিশকে কি ডাকব স্যার?’ মিঃ ভট্টাচার্য মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন। ফোনে মিঃ সোমকে সব কিছু জানিয়ে দিলেন। পুলিশ এলে ফ্যাক্টারি ছেড়ে ছুটলেন হেডঅফিসের দিকে। পুজো আসতে আর মাত্র চারদিন বাকি। সারা ফ্যাক্টারী জুড়ে একটা গম্ভীর থম্‌ থমে ভাব বিরাজমান। সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে প্রেসিডেণ্টের কোন পাত্তা নেই। সকলে কাজে ব্যস্ত কিন্ত কারো মুখে কোন কথা নেই- হাসি দূরঅস্ত। ডিউটি শেষ করে বেরোনোর সময় অরিন্দম দেখল গেটের কাছে স্টেজ করে মাইক লাগিয়ে চতুর্থ ইউনিয়নের নেতারা মিটিং করতে ব্যস্ত। এলাকার এক নামজাদা এম.এল.এ এসেছেন। অরিন্দম পা বাড়াল স্টেশনের দিকে- অনিশ্চয়তার পথে। কানে ভেসে আসতে লাগল মাইক থেকে বেরিয়ে আসা কতগুলি অন্তঃসারশূন্য শব্দসমষ্টী,- “বন্ধুগণ, আপনারা আপনাদের ন্যায্য দাবীতে আন্দোলন চালিয়ে যান। আমরা সবসময় আপনাদের পাশে ছিলাম, আছি আর থাকবোও” - - - - - - - - - - - --