“ঝলমলে দিনে উত্তুরে হাওয়ায় শীতের বার্তা দেবদূত ঘোষাল ফের মতি বদলাল ডিসেম্বরের আবহাওয়া। পশ্চিমী ঝঞ্ঝা গতি বাড়িয়ে উত্তরপ্রদেশ ছেড়ে ঢুকে পড়েছে মধ্যভারতে। বিদর্ভের ঘুর্ণাবর্ত বিলীন। দুর্বল হয়ে গিয়েছে বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপ অক্ষরেখাও। আরও এই ত্র্যহস্পর্শে মধ্যপ্রদেশ-ছত্তীশগড়-ঝাড়খণ্ডের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমে এসেছে এ সময়ের স্বাভাবিকে। যার দরুণ গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে ফের ঢুকে পড়েছে উত্তুরে হাওয়া। রবিবার সকাল থেকে মেঘ সরানো রোদের ঝলমলে আঁচের সঙ্গে সঙ্গে মালুম হয়েছে যার উপস্থিতি। .............” খবরটার এত অবধি পড়ে অমলবাবুর চোখ “আনন্দবাজার পত্রিকা” থেকে সরে চলে গেল দেওয়াল ঘড়ির দিকে। ৮টা বাজে, আর সময় নেই- এখন শুধু ছোটার পালা। তার উপর আজ আবার অফিস যাওয়ার পথে মেয়ে মামনিকে শিয়ালদহে ছেড়ে দিতে হবে। সায়েন্সসিটিতে এক exhibition-এ ও ওর স্কুলকে represent করছে। সময় নষ্ট না করে কাগজ ফেলে রেখে টেবিলে রাখা চায়ের কাপে শেষ চুমুক লাগিয়ে উঠে পড়লেন। যেহেতু সঙ্গে মেয়ে, তাই সময় হাতে নিয়েই স্টেশনে পৌঁছালেন। লক্ষ্য, ৯-২২ এর সোনারপুর লোকাল ধরা, ভিড় এড়াবার জন্য। কিন্ত সোনারপুর রেলস্টেশনে পৌঁছে টিকিট কেটে ম্যানিব্যাগে রাখার সময় একটা বেসুরো ঘোষনা কানে বেজে উঠল- ‘বিশেষ কারণে আজ ৯-২২ এর সোনারপুর লোকাল বাতিল করা হয়েছে।’ মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ব্যস্তময় দিনের শুরুতেই এরকম এক সমস্যায় পড়বেন তা তাঁর ভাবনাতীত ছিল। - তোর ওখানে কটায় পৌঁছানোর কথা? চিন্তিত মুখে মেয়েকে প্রশ্ন করলেন। - সাড়ে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে। হাতে ঘড়ি দেখলেন- ৯-১০ মিনিট। মানে ৯-১২ র বারুইপুর লোকাল হাতে আছে। তারপর ৯-৩০ এর ডায়মণ্ডহারবার লোকাল। স্পষ্টই দেখতে পেলেন সোনারপুর লোকালের ভিড় জড়ো হল বারুইপুর লোকাল ধরার জন্য। - মামনি তৈরী থাকিস, ভিড় হবে কিন্ত। ঠেলে উঠতে হবে। মেয়েকে সাবধান বাণী শুনিয়ে দিলেন। মামনিও মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ঘড়ির কাঁটা যখন ৯-১৫ ছুঁই ছুঁই, ট্রেনের দেখা তখনো মিলল না। অমলবাবু অধৈর্য হয়ে পড়লেন। পাশের লোককে জিজ্ঞাসা করলেন, - ট্রেনের কি কোন গণ্ডগোল চলছে নাকি? - বলতে পারব না দাদা। আমিও অনেক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। - সিগন্যালিং এর কাজ চলছে। তাই ট্রেনগুলো লেট করছে। আরেকজন পাশ থেকে মন্তব্য করলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন অমলবাবু, হঠাৎ চোখে পড়ল বারুইপুর লোকাল প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। চোখের নিমেষে ভিড়টা সারিবদ্ধ হয়ে পড়ল। যেদিকে চোখ পড়ে শুধু মাথা আর মাথা। অফিসটাইম, প্রতিটি কামরায় দরজার কাছে লোক দাঁড়িয়ে আছে প্রতিদিনের মতোই। ট্রেন যখন থামল, গেটের কাছে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা সারিবদ্ধ হয়ে গেটের একটি অংশ বন্ধ করে দিল। ফলে সরু এক ফালি ফাঁকা অংশ পড়ে রইল ওঠানামা করার জন্য। ভেতর থেকে নামল কম। বাইরে ভিড় যেহেতু বেশি, ওঠার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। হুড়োহুড়ির চোটে অমলবাবু বেশ ঘাবড়ে গেলেন। কোনক্রমে মেয়েকে ঠেলেঠুলে ভেতরে পাঠালেন। ব্যস্ততা ও মানসিক চিন্তা যখন একসঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে তখন মানুষ প্রচণ্ড বিচলিত হয়ে পড়ে। অমলবাবুর ক্ষেত্রেও তাই ঘটল। মাথায় একটা চিন্তা পাক খেল- ট্রেনটা ধরতে পারব তো? পরক্ষণেই ভাবলেন মেয়েটা একা রয়ে যাবে। মনের দোটানা ভাবকে ঝেড়ে ফেলে ট্রেনে উঠে পড়লেন। উঠে পড়লেন বটে, কিন্ত ভেতরে ঢোকার অনুমতি মিলল না। প্রতিদিনই যেমন অর্ধেক মানুষ অফিসটাইমে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাদুরঝোলা হয়ে ঝুলতে ঝুলতে যায়, আজ অমলবাবু তাদের সঙ্গী হলেন। পা-টা কোনক্রমে পাদানিতে রাখতে পারলেন, ডান হাতটা দরজা চলাচলের জন্য উপরের ফাঁকা অংশে ঢুকিয়ে দিয়ে আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরলেন। বাঁ হাতটা হাতড়াতে লাগলেন কোন অবলম্বনকে ধরার জন্য। ট্রেন হুইশেল বাজিয়ে প্ল্যাটফর্ম ছাড়ল। - আরে দাদা, ভেতরে ঢুকুন না, বাইরের লোকজন গেটে ঝুলছে। - ঢুকব কি করে? জায়গা কোথায়? - আরে জায়গা কি আপনাকে দিয়ে দেবে? করে নিতে হয়। - তবে আপনি আমার জায়গায় আসুন আর আমি আপনার জায়গায় যাই। ভেতর থেকে নিত্যনৈমিত্তিক ঝগড়া কানে ভেসে এল। অন্যদিন এই ঝগড়া মাথাব্যথার কারণ না হলেও আজ পরিস্থিতি ছিল অন্যরকম। ঝগড়াটা ধাক্কাধাক্কির পর্যায় চলে গেল। ভেতরে আন্দোলনের দোলা যখন বাইরে গিয়ে আছড়ে পড়ল, অমলবাবু প্রথম ধাক্কা দাঁত চেপে সহ্য করলেন। অনুভব করলেন হাতটা ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসছে। ঠেলে ঠুলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলেন, সেইমুহুর্তে দ্বিতীয় ঝটকা খেলেন। আর টাল সামলাতে পারলেন না- ট্রেন থেকে পড়ে গেলেন। সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রনা অনুভব করে সংজ্ঞাহীন হলেন। ট্রেন তখন সোনারপুর থেকে কিছুমাত্র দূর এগিয়েছে। ভিড়ের মধ্যে চাপাচাপি করে অনেকটা ভেতরে ঢুকতে পেরেছিল মামনি। ঢুকেই চোখে পড়ল পাঁচ ছয়জন লোক ভিড়ের মধ্যেই গোল করে দাঁড়িয়ে তাস খেলায় মত্ত। মাঝখানে একটা শূন্যস্থান তৈরী করে রেখেছে। ট্রেনের মধ্যে প্রলয়কাণ্ড ঘটে গেলেও তারা সেই স্থান না ছাড়তে বদ্ধপরিকর। দেখে মামনির মনটা বিরক্তিতে ভরে উঠল। এরই মধ্যে কানে এল-‘ গেল রে!’ ‘কে গেল?’ ‘কি গেল?’ ‘কি হল দাদা?’ – এরকম অনেক প্রশ্ন ট্রেনের এপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে গেল। - একটা লোক ট্রেন থেকে পড়ে গেছে। - পোষ্টে বাড়ি খেয়েছে নাকি? - তা বলতে পারছি না দাদা। মনের মধ্যে একটা খচখচানি শুরু হয়ে গেল। মোবাইল ফোনে যে বাবাকে ধরবে তারও উপায় নেই। ভিড়ের চাপে সোজা হয়ে দাঁড়ানো দায়। শিয়ালদহ অবধি অপেক্ষা করতে হবে। শিয়ালদহে এসে যেন এক জনসমুদ্র চোখের নিমেষে ট্রেনের কামরা থেকে নেমে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। মামনিও নামল। কিন্ত বাবাকে খুঁজে পেল না। প্রতিটি লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল বাবা কিনা। বিচলিত ও উৎকণ্ঠাময় হাত গেল মোবাইল ফোনে। ফোনের রিং বেজে উঠল। রেললাইনের ধারে সারিবদ্ধভাবে ঝুপড়িগুলো দাঁড়িয়ে। ছেলেরা অবসর বিনোদনের জন্য ঝুপড়ি থেকে একটু দূরে বেড়ার এক ক্লাবঘর তৈরী করেছে। পল্টু সকালে একা একা ক্যারাম বোর্ডে ঘুঁটি সাজিয়ে টিপ প্র্যাক্টিসে ব্যস্ত। লাল ঘুঁটিকে সে তাক করছিল। ঘুঁটির অবস্থান সহজ জায়গায় না থাকলেও পল্টুর কাছে তা গর্তে ফেলা ছিল অনায়াসসাধ্য কাজ। বন্ধুমহলে তার অভ্রান্ত টিপ নিয়ে খ্যাতি বিস্তর। ট্রেন যায়, ট্রেন আসে। ট্রেনের শব্দকে সে খুব একটা আমল দেয় না। কিন্ত সেই শব্দের সাথে আজ একটা অন্যরকম শব্দ কানে বাজল। ফলে অন্যমনস্ক পল্টুর ঘুঁটি আর গর্তে পড়ল না। কৌতূহল মেটাতে ঘর থেকে বেরোতেই চক্ষুচড়কগাছ! এক ভদ্রলোক লাইনের ধারে পড়ে আছে। মাথা ফেটেছে, হাত-পা ছড়েছে, ছেঁড়া জামা-প্যাণ্ট রক্তে ভেসে যাচ্ছে। অফিসব্যাগ হাত দুই তিনেক দূরে পড়ে আছে। পল্টু দৌড়ে গেল লোকটির কাছে- জান আছে তবে জ্ঞান নেই। এদিক ওদিক চারপাশ তাকালো- কেউ নেই। এরপর সটান হাত চালিয়ে দিল পকেটে, ম্যানিব্যাগ হস্তগত হল। মোবাইল ফোনটা নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল- আস্ত আছে, বাজারে দাম পাওয়া যাবে। এসব কাজে পল্টু বেশ সিদ্ধহস্ত। রইল পড়ে খেলা, সে ছুটল মার্কেটের দিকে। আজকের দিনের শুরুতে সে যে কার মুখ দেখে উঠেছে- এত টাকা সে একসাথে পাবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি! “বারুইপুর লোকাল থেকে একটা লোক পড়ে গেছে”- খবরটা স্টেশন চত্বরে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। উৎসাহী জনতা ভিড় জমালেন পড়ে থাকা ব্যক্তিকে দেখতে। দুই একজন এগিয়ে এলেন আহত ব্যক্তিকে সেবা করার উদ্দেশ্যে। - করছেন কি মশায়? যাঁরা দাঁড়িয়েছিল তাঁদের মধ্যে থেকে প্রশ্ন উঠল। - ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। - খেপেছেন? এটা রেলের ব্যাপার। ছেড়ে দিন, নয়তো আপনিও ফেঁসে যাবেন। অতএব অমলবাবুকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার চেষ্টায় ভাঁটা পড়ল। সবাই অপেক্ষা করতে থাকলেন রেলের লোক কখন পৌঁছায়। রেলের কর্মীরা এল বেশ খানিক্ষণ পরে। তাদের আসতে দেরী দেখে উপস্থিত জনতার মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হল। এতক্ষণ ধরে একটা লোক পড়ে আছে- রেলের কোন দায়িত্ব নেই? এরই মধ্যে আগত রেলকর্মীরা আবিষ্কার করল অমলবাবুর পকেটে ট্রেনের টিকিট নেই। আদৌ তিনি রেলের যাত্রী কিনা এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে স্থির করল লাইনে পড়ে থাকা ব্যক্তিকে সরিয়ে নিয়ে গেলেও তাঁর চিকিৎসা করার ভার রেলের নয়। একে দেরী করে আসা, তার উপর আহত ব্যক্তির দায়িত্ব না নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা- উত্তেজিত জনতা চুপ করে বসে থাকতে পারলেন না। তাঁরা রেলের কর্মীদের ঘিরে ধরলেন। - যেতে হবে না নিয়ে। চিকিৎসারও দরকার নেই। ইয়ারকি পেয়েছ? - এর একটা প্রতিবাদের দরকার। আমরা আন্দোলন করব। সবাই লাইনের উপর বসে পড়ুন। আমরা অবরোধ করব। সুতরাং অমলবাবুর শরীর ইঞ্চিমাত্র নড়ল না। সকলে বসে পড়লেন অবরোধে। বেগতিক দেখে রেলকর্মীরা পিছু হটল। ছুটল উপরওয়ালাদের খবর দিতে। মোবাইল ফোন্টা অনেকক্ষণ ধরেই বাজছিল। মনের মধ্যে একটা শব্দ বারবার ভেসে আসছিল- ‘জ্বালাতন’। পল্টু ঠিকই করেছিল মোবাইলটা বন্ধ করে দেবে। কিন্ত বন্ধ করতে গিয়েও থমকে গেল। মনটা সায় দিল না। দুর্ঘটনার কেস, চিন্তিত বাড়ির লোকের ফোন করাই স্বাভাবিক। ফোনটা ধরল, - হ্যালো। - হ্যালো বাবা, সেই কখন থেকে ফোন করে যাচ্ছি, তুলছ না কেন? ওপ্রান্তের গলার স্বর এতই মিষ্টি, এতই মধুর- পল্টুর মাথা কেমন হিম হয়ে গেল। বুঝতে পারল না কি বলবে, কি করবে। একটু ভেবে স্থির করল যেটা সত্যি সেটা জানাবে। - আমি তো আপনার বাবা নই। - তাহলে? হ্যাঁ, গলাটাও অন্যরকম। আপনি কে? আমার বাবা কোথায়? - আপনার বাবা সোনারপুর থেকে একটু দূরে ট্রেন থেকে পড়ে গেছে। - ও মা গো! আমি কিছু ভাবতে পারছি না। কি করব। কি হবে? কান্না জড়ানো গলায় মামনি বলে উঠল। মামনির কান্না পল্টুর মনকে ছুঁয়ে গেল। স্বান্তনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, - দেখুন ও পড়ে গেছেন ঠিক, তবে ও জীবিত আছেন। কোন হাসপাতালে নিয়ে গেলে সুস্থ হবে। - আপনি আমায় হেল্প করুন প্লিজ। পল্টু বুঝতে পারল সে ক্রমশ ঘটনার মধ্যে জড়িয়ে পড়ছে। সামনে রবিদার মোবাইল সেণ্টার স্পষ্ট চোখে ভাসতে লাগল। কিন্ত ভেতরে ঢুকতে মন সায় দিল না। - আমি এখন শিয়ালদায় আছি, দয়া করে আপনি বাবাকে পিয়ারলেস নার্সিংহোমে নিয়ে যান। ওটাই কাছে হবে। আমি বাড়িতে মাকে নিয়ে যাচ্ছি। পিয়ারলেস! নামটা সে অনেকবার শুনেছে। কিন্ত জীবনে এই প্রথম সেখানে ঢোকার সুযোগ মিলল। পল্টু দিগভ্রান্ত হল। পথ পরিবর্তন করে ছুটল রেল লাইনের দিকে। খবরটা সোনারপুর স্টেশন থেকে পৌঁছাল শিয়ালদহ স্টেশন চিফ কণ্ট্রোলার সুশান্ত হালদারের কাছে। ফোন তুলে নির্দেশ দিলেন-‘ আমি লোকাল থানায় খবর দিচ্ছি। আপনারা ফোর্স নিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে অবরোধ তুলুন।’ ফোন রেখে ভাবতে লাগলেন রেলের শোচনীয় পরিণতির কথা। খবরটা শুনে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ চোখ গেল দেওয়ালে টাঙানো একটা চার্টের দিকে,- দৈনিক রেলযাত্রীর সংখ্যা- টিকিট যাত্রী – ১০,০০,০০০ বিনা টিকিট যাত্রী – ৭,০০,০০০ মোট যাত্রী – ১৭,০০,০০০ মোট ট্রেন সংখ্যা- ৮৩ (গড়)কারশেডগামী ট্রেন সংখ্যা- ৮ দৈনিক ব্যবহৃত ট্রেন সংখ্যা- ৭৫ চার্টের সংখ্যাগুলো একটা অলিখিত তথ্য দিল। প্রতি ট্রেনের দৈনিক ট্রিপ যদি ৭৭০ বার হয়, ৭৫ টা ট্রেন বিভিন্ন রুটে প্রতি ট্রিপ পিছু ২২০৭ জন যাত্রী বহন করে। অথচ প্রতিটি ট্রেনের সামর্থ্য ২১০০ জন যাত্রী বহন করার। অর্থাৎ প্রতিদিন বাড়তি ১০০ থেকে ১৫০ জন লোকের চাপ প্রতিটি লোকাল বহন করছে। যখন অফিসটাইম হয়, তখন এই পরিস্থিতি আরো মারাত্মক আকার ধারণ করে। বুঝলেন যে বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করলে যা ঘটেছে সেটাই স্বাভাবিক- সেটাই বাস্তব। মনটা কিছুটা হাল্কা হল। কাজে মন দিলেন সুশান্তবাবু। দূর থেকে পুলিশ সহ রেলের এক অফিসারকে আসতে দেখে অবরোধকারী জনতার মধ্যে ক্ষোভের ঢেউ উথলে উঠল। - কি ভেবেছেন কি? পুলিশ দিয়ে আমাদের মেরে তুলবেন? - অফিসটাইমে আমাদের তো গরুছাগলের মত ঝুলে যেতে হয়, তা নিয়ে তো আপনাদের তো কোন দায়িত্ব নেই। - একটা লোক ট্রেন থেকে পড়ে গেল, আপনাদের কোন দায়িত্ব নেই? রেল অফিসার এত লোকের এত প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে প্রথমে ঘাবড়ে গেলেন। রেল অফিসারকে ঘিরে থাকা জনতার পিছনের সারির এক ভদ্রলোক, যিনি বেশ গভীর মনোযোগ সহকারে ঘটনাটা দেখছিলেন তিনি অনুভব করলেন কেউ যেন পিছন থেকে ডাকছে। তাকিয়ে দেখলেন একটি কিশোর তাঁকে বলছে, - কাকা, একটু হাত লাগাও না। লোকটাকে তুলে মেন রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে যাব। - দেখছিস না রেল অফিসারকে ঘেরাও করা হয়েছে? বিরিক্ত করিস না। যা ভাগ। লে পচা। মনে মনে পল্টু বলে উঠল। বুঝল, তাকে সাহায্য করতে কেউ ইচ্ছুক নয় আর হবেও না। সুতরাং সে আর কিছুমাত্র না ভেবে সবার অলক্ষ্যে অমলবাবুকে কাঁধে তুলে ছুটল মেন রাস্তার দিকে। যেতে হবে পিয়ারলেস। টাকার জন্য কোন ভাবনা নেই- ভদ্রলোকের ধার করা মানিব্যাগটাই ভরসা। লাভের লাভ কিছু হল না, ভোগান্তি খানিকটা হচ্ছে বটে, কিন্ত এই বেগার খেটেও মনের ভেতর একটি শান্তি পাচ্ছে- সাথে একটা আনন্দও হচ্ছে। মেন রাস্তায় এসে পল্টু হাতছানি দিয়ে ডাকল – ট্যাক্সি.......... রেল অফিসার প্রাথমিক ঘাবড়ানি কাটিয়ে উঠে বললেন, - দেখুন রেলের নিয়ম অনুযায়ী দরজায় ঝুলে যাওয়া নিয়মবিরুদ্ধ। সেক্ষেত্রে আপনারা যদি স্বেচ্ছায় ঝুলে ঝুলে যান তার দায় রেল কেন নেবে বলুন। আর বিশ্বাস করুন, আমি আপনাদের মতই সাধারণ মানুষ। ঊর্দ্ধতন অফিসারের নির্দেশেই পুলিশ নিয়ে এসেছি, আপনাদের মেরে তুলতে নয়। - ঠিক আছে, ঠিক আছে। রেলের টিকিট কেটে যে আমরা যাই, কিন্ত ঠিকমত পরিষেবা মেলে না কেন? - আপনাদের এই অসুবিধার কথা চিন্তা করেই তো ৯টা বগি থেকে ১২ বগি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কাজও চলছে সেইমত।আমার অনুরোধ, আপনারা দয়া করে অবরোধ তুলে নিন। অফিসারের কথায় অবরোধকারীরা অধিকাংশই নরম হলেন। কিন্ত অশান্ত কেউ কেউ প্রশ্নবাণ ছুঁড়তে দেরী করলেন না, - সেই কখন থেকে একটা লোক ট্রেন থেকে পড়ে গেছে। আপনারা কোন ব্যবস্থা নেন নি কেন? - সত্যি এটা আমাদের গাফিলতি। আমি রেলের পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমরা ওনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। দয়া করে ওনার কাছে নিয়ে চলুন। অফিসারের বরংবার অনুরোধে এবং বিনয়ী ভাষণে সব ক্ষোভ নিমেষে উধাও হল। অবরোধকারীদের মাথারা এগিয়ে এলেন আহত ব্যক্তির কাছে তাঁকে নিয়ে যেতে। কিন্ত লাইনের ধারে যেতেই সকলে তাজ্জব হয়ে গেলেন। কোথায় আহত ব্যক্তি – কোথায় অমলবাবু? সব কিছু ভোঁ-ভাঁ, কোথাও কোন পড়ে থাকা ব্যক্তির চিহ্ন নেই। সকলেই হতবাক্‌ হয়ে অবিশ্বাস্য চোখে পরষ্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। আর অফিসার সন্দেহ ভরা চোখে দেখতে লাগলেন আন্দোলনকারী মাথাদের। -------------------------------------------