রাজকুমার রায়চৌধুরী


ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল।বৈশালী আবার চেষ্টা করল ফোন করে বিনোদকে ধরার।কিন্ত বিফল প্রচেষ্টা, ধরা গেল না। যথারীতি এক সুর কানের কাছে বেজে উঠল-“ the number is not responding, please try after some timeফোনে বিনোদকে না পাওয়ার বিরক্তি তার চোখে মুখে ফুটে উঠল।যত রাগ গিয়ে পড়ল ফোনটার উপর। রেগেমেগে ভাবল যত নষ্টের গোড়া এই ফোন। ফোন ছিল বলেই তার বিনোদের সাথে আলাপ হয়েছিল, ফোন ছিল বলেই অনর্থক এসএমএস এর পালা লেগেছিল, শুতে যাওয়ার আগে রোজ বলত-“ Goodnight baby, আভি শোনে যা রাহা হুঁ, কাল ফির মিলেংগে।” সেই বিনোদ তার ফোন ধরছে না। বিনোদ পাল্টে গেছে।

হঠাৎ আনমনা চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বৈশালী দেখল তার রিক্সাটা ইন্দিরাপুরমের CISF camp আর NH 24 এর সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে আছে যে কে সেই। রাস্তায় প্রচুর গাড়ি- জ্যাম। জ্যামকে এড়ানোর জন্যই রিক্সাটা wrong route নিয়েছিল। গাজিয়াবাদে যা হামেশাই হয়ে থাকে, তবুও জ্যাম থেকে নিস্তার নেই। অগত্যা অজান্তেই বৈশালী কানে হেড গুঁজে মোবাইলে গান চালিয়ে দিল। গান শুনতে শুনতে মন কিছুটা শান্ত হল। ফোনটা বন্ধুও বটে। ভিড় রাস্তায় এই রকম নিবিড় সঙ্গতা তাকে আর কে দিতে পারে?

বৈশালী গাজিয়াবাদের শিপ্রা সানসিটিতে থাকে। সে Noida 62 এর কাছে Jaypee College ম্যানেজমেণ্টে ১ম বর্ষের ছাত্রী।স্বভাবশতঃ সে খুব মিশুকে এবং পয়সা ওড়াতে তার জুড়িমেলা ভার। সে কারণে বন্ধুও জুটে গেল চটজলদি। বিনোদ তাদের মধ্যে একজন।যদিও সে তার কলেজের নয়, তবে এক পরিচিত ঠেকে তাদের আলাপ।

অন্যদের চোখে বিনোদ খুব নির্ভরযোগ্য না হলেও ওর স্মার্টনেস, লোকের সাথে কথা বলার ধরণ,ওর রূপ বৈশালীকে খুব আকৃষ্ট করত। সব থেকে বড় কথা বিনোদের হেরে গিয়েও না হারার প্রতি অদম্য উৎসাহ, যুক্তি সহকারে  নিজেকে সঠিক প্রতিস্থাপনার চেষ্টাকে বৈশালী মনে মনে তারিফ করত। সেই কারণেই বিনোদের সাথে তার বেশী খাতির। আর এই খাতিরতার পাখা মেলে বিনোদের সাথে বন্ধুত্বটা গাঢ় হয়েছিল।বিনোদ ওকে সিগারেট খাওয়া, বারে যাওয়া শিখিয়েছিল।বারে ওরা একসাথে নাচও করেছিল। নাচ করতে করতে বিনোদ ওর কাছে এসেছিল, গলা জড়িয়ে মুখে মুখ রেখেছিল-ও নীরব প্রশ্রয়ও দিয়েছিল।

রিক্সা থেকে নেমে কলেজের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পরিচিত ঠেকে উঁকি মারল বৈশালী বিনোদের দেখা পাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্ত বিনোদের কোন পাত্তা নেই। বিরক্ত হয়ে সে আবার ফোনে ধরার চেষ্টা করল। অবশেষে ফোনটা লাগল। ওপ্রান্ত থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এল;-

-  হ্যালো।

-  আরে কাঁহা হ্যায় তু?ফন কিঁউ নেহি উঠায়া মেরা?কোন্‌সা মহান কাম ক্র রাহা থা তু নে?

রাগে ফেটে পড়ল বৈশালী। সমস্ত রাগ এক নিমেষে উজাড় করে দিল সে।

-  আরে ইয়ার বাইক চালা রাহা থা। ইস লিয়ে ফোন উঠায়া নেহি।

ওই প্রান্তের উত্তরে কোন ভাবান্তর এল না।জবাব যেন ঠোঁটের আগায় রাখা ছিল। জবাব এমনি যে এর পর কোন প্রশ্ন উঠতে পারে না।তাই বৈশালী খানিক থমকে গেল।কি বলবে ভেবে উঠতে না উঠতেই বিনোদ বলে বসল;

-  আরে শুন না, হামকো পাঁচ হাজার রূপাইয়া চাহিয়ে। জুগাড় করকে রাখিও।

-  পাঁচ হাজার!মগর কিস লিয়ে? চোখ কপালে উঠল বৈশালীর। পিছলে মাহিনেই মে তো দো হাজার লিয়া থা তু নে।আভি কিস লিয়ে চাহিয়ে?

-  হাঁ ভাই, কাম হ্যায় থোড়া। আগলে মাহিনে মে হিসাব চুক্কা কর দেঙ্গে।ফিকর না করিও।

সারা দিনের ক্লাস তার ঠিকমত করা হল না।পাঁচ হাজার টাকার ভূত মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। গত মাসে উইক এণ্ডে দিল্লীর কাছে একটা হোটেলে তারা রাত কাটিয়েছিল। সেখানেই দুই হাজার টাকা বেরিয়েছিল। যদিও খানা পিনার যোগান বিনোদই করেছিল। আবার পাঁচ হাকার টাকা কি জন্য কে জানে। এত টাকা জোগাড় করবে কি করে? মাথাটা ভারী হতে লাগল। বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। চোখে পড়ল ড্রেসিং টেবিলে রাখা ল্যাপটপটা। গতবছর জন্মদিনে বাবার দেওয়া উপহার। ল্যাপটপ আসার পরে যখনই মন খারাপ হয়, মাথা ভার হয়, অতিরিক্ত টেনশন অনুভব করে তখনই ল্যাপটপকে সাথী করে নেয়। এখানে সে তার মনের বোঝা উজাড় করে দিতে পারে, কথা বলে হাল্কা হতে পারে। কখনো কারো কাছে ভাল টিপস পায়, কেউ আবার আহা উহু করে। আর ল্যপটপ বন্ধ হলেই সব কিছু শেষ। কারো সাথে সে রকম যোগাযোগ নেই। মোবাইলের পরে নিবিড় বন্ধু বলতে ল্যাপটপ বলতে আর কেউ নেই। ল্যাপ্টপ খুলে সে yahoo chat   ‘Vaishali_026’ নামে ঢুকে পড়ল।


আজ শনিবার। ট্রেন এমনিতেই ফাঁকা। তার উপর উল্টোদিকের ট্রেন। বালিগঞ্জ থেকে দরজার কাছে হাওয়া খেতে খেতে দমদম যাচ্ছে। অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছে তাড়াতাড়ি। অন্যদিন হলে সন্ধ্যা ৭টা বা ৮টা normalআজ শনিবার বলে বিকাল তিনটে। মনটা বেশ ফুরফুরে আছে আজ। বৌ গেছে বাপের বাড়ি ২ বছরের ছেলেকে নিয়ে। ফলে ঘর এখন ফাঁকা।  বহুদিন পর ব্যাচেলার জীবন উপভোগ করার সুযোগ এসেছে। বাড়ি গিয়ে চা টা বানিয়ে নেবে। তারপর রাতের খাবার বাইরে থেকে আনিয়ে নেবে। আর কি! অফুরন্ত সময় পড়ে আছে তার হাতে। সামনের সপ্তাহে বৌ না আসা পর্যন্ত তাকে পায় কে? এই অফুরন্ত সময়ে কি কি মস্তি করা যায় তার ভাবনা চিন্তায় সে বিভোর। মাল খাওয়া তো মামুলি ব্যাপার, আর কি কি করা যেতে পারে তার লিস্ট করতে সে মশগুল হয়ে পড়ল।

হঠাৎ একটা আলতো স্পর্শে তার চমক ভাঙল। এক ভিখারী তার কাছে পয়সা চাইছে। নিমেষের মধ্যে তার চিন্তাসূত্রে ছেদ পড়ল। বিরক্তিভরা মুখে চোখের ইসারায় না করে দিল। কিন্ত মন থেকে ব্যাপারটা মুছে দিতে পারল না। তার চিন্তার অভিমুখ ঘুরে গেল। ভিখারীকে সাহায্য করা উচিত কিনা –ছোটবেলা থেকে যে দ্বন্দ্ব চিরকাল তার মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে এসেছে, কিন্ত কোন সমাধান সূত্র সে পায় নি। পক্ষে বিপক্ষে দুই তরফেই অনেক যুক্তি আছে। বিশেষত খবরের কাগজের ভিখারীদের নিয়ে খবরগুলো তাকে সাহায্য করতে নিবৃত্ত করে। তাই তার যখন ইচ্ছা জাগে তখন পয়সা দেয় আর অন্যসময় চুপ থাকে।

বাড়ি ফিরে ফ্রেস হয়ে নিয়ে টেবিলের উপর পড়ে থাকা ল্যাপটপের দিকে চেয়ে মায়া হল। ধুলো পড়ে গেছে - কতদিন বসা হয় না আরাধনায়। net surfing কে সে আরাধনাই জ্ঞান করে। কারণ একবার বসলে সময় স্রোতের মত বয়ে যায়। হুঁস থাকে না। আসলে বাড়িতে বাচ্চা থাকলে নিজের আমোদ প্রমোদের জায়গা কমে যায়। অন্তত তন্ময়ের মত ভাবুক, পরোপকারী ছেলেদের ক্ষেত্রে। মনের ইচ্ছাটা আবার দপ্‌ করে জ্বলে উঠল - আজ বসতে হবে।

‘Tanmoy_here_for _you’  নাম নিয়ে yahoo chat  এর অনেক ঘর ঘুরে চোখে পড়ল  ‘Vaishali_026’ id তে। hi করে ping করার সঙ্গে সঙ্গে জবাব স্ক্রীনে ভেসে উঠল;

-      Hi....asl?

তন্ময় যখন নেটে বসে তখন স্বভাবতই বয়স একটু কমিয়ে নেয়। নয়তো উঠতি ছেলেমেয়েদের কাছে পাত্তা পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রেও সে একই পন্থা অবলম্বন করল। প্রাথমিক পরিচয়ের পর্ব শেষ করে তন্ময় যখন ভাবল web cam বা voice chat   অন্যপ্রান্তে বসা ব্যক্তির পরিচয় যাচাই করবে কিনা, তখনই চোখের সামনে ভেসে উঠল;

-      I’m in a problem. Can you help me out?

মানুষের জীবন তো সমস্যাপূর্ণ। কিন্ত তন্ময় পরোপকারী ছেলে। কেউ সাহায্য চাইলে মুখের উপর না করতে পারে না। জিজ্ঞাসা করল;

-   What’s your problem? Will you explain me please?



-      I need 5000 bucks. Will you lend me?

পাঁচ হাজার টাকা! বলে কি রে বাবা! তন্ময়ের মাথা ঘুরে গেল একবার বন্‌ বন্‌ করে। কিছুক্ষণ ভেবে আবার সে chat এ মন দিল।




chat ভালই জমে উঠেছিল। আর বৈশালী এতক্ষণ তন্ময়ের সাথে কথা বলে মনে মনে ভেবে নিয়েছিল যদি নিজের সমস্যা খুলে বলা যায় তো কেমন হয়। সে অনুযায়ী সে বলেওছিল। কিন্ত পাঁচ হাজার টাকা দাবী করার পর তার কাছে প্রশ্নটা এল যে সে থাকে কোথায় আর কি জন্য তার এত টাকার দরকার। সে আগে থেকেই জানত যে তার কাছে এ প্রশ্ন আসবেই। সে তৈরীই ছিল একপ্রকার।

যেহেতু তন্ময় কোলকাতার ছেলে, আর তার মাসীর বাড়ি থাকার সূত্রে দীর্ঘদিনের যাতায়াত, সে লিখল দঃ কোলকাতায় সে থাকে।

পরের প্রশ্নের উত্তরে সে জানাল ম্যানেজমেণ্টের প্রাইভেট টিউশনের ফিস দিতে তার এই টাকা লাগবে।

সত্য জিনিস একরকম আর মিথ্যা জিনিসটা অন্যরকম। চাল ভাতে বাড়ার মত মিথ্যার জাল ক্রমশই বড় হতে থাকে। সামলানো দায় হয়ে পড়ে। কিন্ত বৈশালী এ ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। সে কিছুটা সত্যি, কিছুটা কল্পনার আশ্রয়ে অপর প্রান্তকে বোঝানোর চেষ্টায় রত থাকল যে কেন তার টাকা দরকার। সে জানাল তার বাবা Merchant Navy তে কাজ করে এবং টিউশন ফি advance payment করে গেছিল। কিন্ত তার খরচের হাত এত বেশী আর বন্ধু বান্ধবের সাথে হৈ হুল্লোড় করতে গিয়ে ঘাটতি পড়ে গেছে। বাড়িতে বলার অর্থ এক অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হওয়া। তাই সে টাকা চায়। অবশ্য সে টাকা পরে শোধ করে দেবে বলে জানাল।

বৈশালীর বক্তব্য শুনে তন্ময় কিছুটা নরম হল। তার কলেজ জীবনের কথা মনে পড়ে গেল। এক সময় সেও কি কম পয়সা উড়িয়েছে? আসলে এই বয়সটাই এরকম, ভুল ভ্রান্তির বয়স। এ সব চিন্তা করতে করতে তন্ময়ের মনে খটকা লাগল- কোলকাতায় টিউশন ফি পাঁচ হাজার টাকা? ঢপ মারছে না তো? সে প্রশ্ন রাখল;

-   কোলকাতায় কোন টিউশন ফি পাঁচ হাজার টাকা হতে পারে না, বড়জোর দুই।  কি করে এত টাকা দাবী করছ?

বৈশালী জানে যে কোলকাতা বেশ সস্তার শহর। কিন্ত প্রাইভেট টিউশন ফি কত হতে পারে এ সম্বন্ধে তার ধারণা বিশেষ ছিল না। তাই এবার তাকে সত্যি কথা বলতে হল। সে জানাল যে সে দিল্লীতে থাকে  আর সেখানে ম্যানেজমেণ্ট পড়ছে। আর ওখানকার ফি এরকমই। কিন্ত তখনই প্রশ্ন এল যে সে টাকাটা শোধ করবে কি ভাবে? সত্য বলতে টাকা শোধের ইচ্ছা তার আদৌ ছিল না। তবুও বলার কথা তাই সে জানাল কোলকাতায় ফিরে সে তার সাথে দেখা করবে। মিথ্যা কথার ধারা বর্ষাতে বর্ষাতে সে মনে মনে বিনোদের প্রতি খুব বিরক্ত হয়ে উঠল। মনে মনে বিনোদের প্রতি তার খুব রাগ হল- “দ্যাখ বিনোদ, দ্যাখ। তোর জন্য আমাকে এসব করতে হচ্ছে। আর তুই! আমাকে পাত্তা দিস না”।

 চ্যাটিং আর বেশীদূর এগোল না। দুই তরফই অতিরিক্ত কৌতূহল এবং জিজ্ঞাসা নিয়ে বিদায় নিল।  তন্ময় মনে মনে ভাবল যে মেয়েটা যা বলছে তা আদৌ সত্যি কিনা সন্দেহ। যদিও বা পয়সা দেয় তবে তা পাওয়ার আশা করাই বৃথা। অন্যদিকে বৈশালী নিজের নির্বুদ্ধিতাকে দোষ দিতে থাকল। কেনই বা সে এত বেশী টাকা চেয়ে বসল, কেনই বা সে কোলকাতার টিউশন ফির খবর আগে থেকে জানল না- এইসব। তবে মনে মনে তারিফ করল এই ভেবে যে সে তন্ময়কে নিজের friend list Ad করেছে। পরে সময়মতো নতুনভাবে ভেবে কথা বলতে হবে।

পরদিন সকালবেলা কলেগের সামনে নামতেই বিনোদ এসে হাজির। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল। অবাক চোখে তাকিয়ে রইল বৈশালী। ভেবে পেল না রাগে ফেটে পড়বে না হাসিমুখে কথা বলবে। কিন্ত তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বিনোদ বলে উঠল;

-   হাঁ ভাই, জুগাড় হুয়া?

এবার বৈশালীর মাথা দপ্‌ করে জ্বলে উঠল। অর্থাৎ বিনোদ তাকে দেখতে বা তার সাথে কথা বলতে আসে নি, এসেছে টাকার সন্ধানে। তবুও মাথা ঠাণ্ডা করে প্রশ্ন করল;

-   তেরে কো ইতনা পাইসা কিঁউ চাহিয়ে?

-   বোলা না কাম হ্যায়।

-   কেয়া কাম? উও তো বাতাও।

-   ইসকা জবাব ম্যায় নেহি দুঙ্গা, ঠিক হ্যায়?

অবাক হল বৈশালী। টাকা যোগাবে সে, কিন্ত কি জন্য যোগাচ্ছে তা জানতে গেলে উত্তর হল ব্যক্তিগত ব্যাপার, নাক না গলানোই ভাল। সে রেগেমেগে চেঁচিয়ে বলল;

-   ঠিক হ্যায়, আগর তু বোল নেহি সাকতা হ্যায় তো পাইসা দেনে কে লিয়ে ম্যায় ভি রাজী নেহি হুঁ। চল, ভাগ ইঁহাসে।

তার এই উত্তরে বিনোদের ভ্রু কুঁচকে গেল। চোখে মুখে বিরক্তির ভাব স্পষ্টতঃ ফুটে উঠল। আশাহত বিনোদ কঠিন মুখে ঘাড় ঘুরিয়ে চলে গেল।

বৈশালীর সারা শরীর থরথরিয়ে কাঁপছিল। সে বুঝে পেল না যে কিভাবে এত বড় কাণ্ডটা ঘটাতে পারল। কারণ এর আগে সে কখনো এত বাজে ব্যবহার করে নি- এই প্রথম।

সকালের ঘটনার সে সারাদিন কখনোই ভুলতে পারল না। যতবার সে ভোলার চেষ্টা করে ততবারই তার ঘটনাটার কথা মনে পড়ে যায়। সে মনে করে যে যা করা হয়েছে তা ঠিকই হয়েছে। কিন্ত পরক্ষণেই বিনোদের প্রতি নিজের ব্যবহারের জন্য দুঃখবোধ করে। মনের মধ্যে এক দ্বন্দ্ব চলতে থাকে ঠিক বেঠিকের।  বুঝে উঠতে পারে না তাকে সাহায্য করা উচিৎ ছিল কি ছিল না। সন্ধ্যাবেলা এসে আবার সে নেটের শরণাপন্ন হয়।

নেট খুলে yahoo chat  ‘Tanmoy_here_for _you’ online আছেকথা বলবে কি বলবে না ভাবতে ভাবতে hi করে বসল। তন্ময় উত্তর দিল hiকিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বৈশালী ভাবল যদি সে টাকা চাওয়ার কথা না করে দেয় তবে সেটা খারাপ দেখায়। তাই সে প্রসন রাখল;

-   আপনি আমার সাহায্যের কথা কি ভাবলেন?

তন্ময় ভেবেই রেখেছিল যে এ বিষয়ে আর এগোবে না। অত টাকা দান করে নিজেকে মহানুভব প্রতিপন্ন করার মধ্যে বোকামি ছাড়া আর কিছু লকিয়ে নেই। তাই সে কড়া ভাষায় লিখল;

-   টাকা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সরি

-   কেন?

-   প্রথমতঃ অত বড় amount আমার দেওয়া সম্ভব নয়। দ্বিতীয়তঃ কবে ফেরৎ পাব বা আদৌ পাব কিনা তা পরিষ্কার নয় আর তৃতীয়তঃ তোমায় টাকা দিয়ে আমার কি লাভ?

কথাগুলো যুক্তিসঙ্গত। বৈশালীরও এই কথাগুলো মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলকিন্ত তন্ময়ের সোজাসুজি কড়া ভাষার কথা তার আঁতে ঘা দিল। টাকা হাতানোর জন্য একটা জেদ চেপে বসল। বিনোদের জন্য না হলেও সে অন্ততঃ নিজের জন্য খরচা করবে। মাথায় একটা দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল। পুরুষ মানুষের দুর্বলতা কোথায় আছে তা হাড়ে হাড়ে তার জানা আছে। সে লিখল;

-   তোমার তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর আগে দি। যদি তুমি আমায় সাহায্য কর তবে তুমি যা চাইবে তাই পাবে। তোমার জন্য আমি CAM show করতে পারি রোজ। অতএব সাহায্য করা বা না করা তোমার ব্যাপার।

বলে কি মেয়েটা! সাংঘাতিক। আসলে ছেলে আসার পর থেকে একসাথে শুলেও রাতগুলো বেশ নিরামিষই কাটতএকসাথে থেকেও তন্ময় সন্ন্যাসীদের মত সংযম পালন করে। সেই সংযমের দরজায় আজ আচমকা ঘা পড়েছে। তন্ময় সাড়া না দিয়ে থাকতে পারল না। সে সন্দেহ মনে লিখল;

-   আমার এখন দুটো প্রশ্নের উত্তর জানা বাকী আছে।

-   দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে জানাই সামনের মাসের ৫ তারিখে তোমার সাথে আমার দেখা হচ্ছে। জায়গা তুমিই বলে দেবে। তবে দঃ কোলকাতা হলে ভাল হয়।

-   সে তো হল। কিন্ত অত টাকা আমার দেওয়া সম্ভব নয়।

-   কত দিতে পারবে?

তন্ময় হিসাব করে দেখল সে দুই যদিও দিতে পারে তবুও হাজার দিয়ে শুরু করাই ভাল।

-   ১০০০ টাকা।

-   আড়াই দাও। কাজ চালিয়ে নেব।

-   দুই নাও।এর থেকে বেশী দিতে পারছি না।

বৈশালী আর কথা বাড়াল না। শেষমেষ দুইতেই রাজি হয়ে গেল। টোপ গিলে মাছ যে জালে ধরা দিয়েছে সেটা সে ভাল করেই বুঝেছিল।

-   ঠিক আছে, তাই দাও। তবে টাকা ঘরে এলেই চাম শো নচেৎ নয়।

-   সে ঠিক আছে কিন্ত টাকা পাঠাব কি করে?

বৈশালী তার bank account no দিয়ে নেট মারফৎ টাকা পাঠাতে নির্দেশ দিয়ে সেদিনের মত বিদায় জানাল। মনটা তার বেশ হাল্কা লাগছে। টাকা কত পেল সেটা তার কাছে বড় ব্যাপার নয়, বরং তার নিজস্ব মুন্সিয়ানায় একটা লোককে কি করে মুরগা বানাতে পারল এটাই তার কাছে বড় ব্যাপার। নিজের কাবিলিয়তের প্রতি সে খুব গর্ব অনুভব করল।

টাকা তার অ্যাকাউণ্টে আসতে বেশী সময় নিল না। কলেজের সামনে ATM থেকে খোঁজ নিতেই দুই হাজার টাকার হদিস মিলল। চোখ দুটো খুশীতে জ্বলে উঠল। মুহুর্তের মধ্যে সকল রাগ ভুলে বিনোদের খোঁজে পুরোনো ঠেকের দিকে ছুটল। কিন্ত বিনোদ কোথায়? তার কোন হদিশ নেই। হতাশার চাহনিতে এদিক ওদিক নজর করে পরিচিত এক বন্ধুকে সে জিজ্ঞাসা করল;

-   বিনোদ কাঁহা হ্যায় রে?

-   আরে উসকা নাম না লো তো আচ্ছা হ্যায়।

-   কিঁউ? কেয়া হুয়া?

-   আরে না জানে কোনসা ফরেন লেডকী কে সাথ ঘুম রাহা হ্যায় অউর সব সে উধার মাঙ্গকে উসকী পিছে উড়া রাহা হ্যায়।

হঠাৎ কেউ যেন তার গালে প্রচণ্ড জোরে চড় কষাল। মুহুর্তের মধ্যে তার সকল আনন্দ এক নিমেষে উধাও হয়ে গেল। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। ঠেকের ফুটপাতে ধপ্‌ করে বসে পড়ল।


টাকাটা দেওয়ার পর থেকে তন্ময় যেন এক অস্বস্তিতে পড়েছিল।টাকা দেওয়ার আগে যদিও বা সে চ্যাটে তাদের মিলনস্থল কোথায় হবে তা জানাতে পেরেছিল, কিন্ত টাকা দেওয়ার পরে একদিনও বৈশালীকে online দেখল না।

যদিও সে ভাল করেই জানত টাকা ফিরে পাওয়া দুরূহ কাজ, তবুও ঝোঁকের বশে সে তা দিয়ে ফেলেছিল। দিয়েছিল কৌতূহলবশতঃ, শিক্ষা নেওয়ার তাগিদে। ভবিষ্যতে এই ধরণের ক্ষেত্রে তার কর্মপন্থা কি হবে তা জানার ইচ্ছায়। কিন্ত এই টাকা দেওয়ার পর সীমাহীন অপেক্ষা তাকে মানসিকভাবে পীড়া দান করছিল। নিজের নির্বুদ্ধিতাকে বার বার দায়ী করছিল।

 বৃথা আশা যে মরেও মরে না। তাই সে পরের মাসের ৫ তারিখ ছুটল তাদের আগাম ঘোষিত জায়গায় দেখা করার উদ্দেশ্যে। অনেক সময় অতিক্রান্ত, বৈশালীর দেখা আর নেই। সে বাড়ি ফেরার জন্য মন স্থির করল, হঠাৎ এক আলতো স্পর্শ তার কাঁধে এসে লাগল। আচমকা ফিরে তাকিয়ে দেখল – এক মাঝ বয়েসী ভিখারী মহিলা, গায়ে শতচ্ছিন্ন ময়লা কাপড়, চুল উসকো খুসকো। তার কাছে এসেছে ভিক্ষা চাইতে। তন্ময়ের মুখে হাসি ফুটে গেল। সে আর এক মুহুর্ত না ভেবে পকেট থেকে পাঁচশ টাকার নোট ভিখারীর হাতে গুঁজে সোজা হাঁটা মারল। অবাক চোখে ভিখারী মহিলা একবার নোটের দিকে আবার চলমান মহানুভব লোকটির দিকে তাকাতে থাকল।