আরব সাগরের সান্নিধ্যে











২০শে ডিসেম্বর,২০০৮,শনিবার। দুপুর ১১:৩০। তখন আমি অফিসে। একটা ফোন এল।

-May I talk to Mr. Rajkumar Raychaudhuri?

-Speaking.

-Sir, I’m Suman from King Fisher Airlines Customer Service. Your tomorrow morning flight has been cancelled and you have to board on flight no 432 at 5:50 pm on same day.

আমি অবাক। বিনা মেঘে বজ্রপাত। cancelled?? কেন?? ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিল বিস্তারিত খবর জানতে তাদের customer care এ ফোন করতে। কিছুক্ষনের জন্য চারিদিকে ধোঁয়াশা দেখতে লাগলাম। ২১শে ডিসেম্বর আমাদের ব্যঙ্গালোর যাওয়ার কথা। flight ছিল সকাল ৭:৫০মি। সেই টিকিট প্রায় তিনমাস আগে থেকে বুকিং করা। শুধু তাই নয়, ব্যঙ্গালোর থেকে গোয়া যাওয়ার train এবং গোয়ায় থাকার হোটেল আর সেখান থেকে মুম্বাই হয়ে কোলকাতায় ফিরে আসার train ticket সব কিছুই। শুধু ব্যঙ্গালোরের হোটেল ছাড়া। কারণ ওটা আমার পরিচিত জায়গা।

বাড়িতে ফোন লাগালাম। আমার গৃহকত্রী পৌলমী যথেষ্টই অবাক। জানতে চাইল আমার পরবর্তী পদক্ষেপ কি? জানালাম দমদম এয়ারপোর্টে গিয়ে বিস্তারিত খবর নেব। ও পরামর্শ দিল গোয়ার হোটেলে ফোন করে জানতে বুকিং ঠিকমত হয়েছে কিনা। গোয়ার হোটেল সুখসাগরে ফোন লাগালাম। জানতে চাইলাম ২৪ তারিখ থেকে ২৮ তারিখ অবধি T.T.M.I এর মাধ্যমে যে রুম বুকিং করা আছে তা confirmed কিনা। খানিক বাদে তারা জানাল,

-Sir, Room is booked for Mr. Rajkumar Chakravarty but not in the name of Rajkumar Raychaudhuri.

নিজের বিস্ময় কোনক্রমে সামলে বললাম,

- That fellow must not be R.K. Chakravarty, it’s me R.K. Raychaudhuri.

- What ever may it be. You must bring your I-card when you come to the hotel, otherwise we won’t entertain you.

বুঝলাম ২৬/১১-র মুম্বাই হামলার রেশ গোয়ার উপরও পড়তে পারে ধরে নিয়ে আগাম সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে। তাই অবাক হলাম না।

দমদম এয়ারপোর্টে গিয়ে জানলাম আমরা তিনমাস আগে King fisher Red (Deccan) এর flight বুকিং করেছিলাম, সেটা উঠে গেছে। তাই ওর বদলে সন্ধ্যার flight বুকিং করা হয়েছে। ব্যাঙ্গালোরে সেটা পৌঁছাবে রাত ১০:৩০ থেকে ১১টার মধ্যে। খবর নিয়ে জেনেছিলাম এয়ারপোর্ট শহর থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। ফলে অত রাতে পৌঁছে কি করব, কোথায় যাব- তা চিন্তা করে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। যদিও আমার একটা বন্ধু বলেছিল সারারাত বাস সার্ভিস আছে, কিন্তু লোকাল বাস রাত ১২টার পর চলে না - তা আমি জানতাম। তাই বাবাকে বলে একটা প্রাইভেট কারের ব্যবস্থা করে রাখলাম।

এয়ারপোর্টে এসে মনটা অন্যরকম হয়ে গেল। চিন্তাভাবনা কোথায় এক নিমেষে উবে গেল। আরো ভালো লাগলো যখন আমরা প্লেনে চড়লাম। অত্যাধুনিক সাজসরঞ্জামে ভরপুর ভিডিও কোচ প্লেন। প্রতিটি সিটের সামনে ছোটো টিভিস্ক্রিন। Airhostess প্লেন চলার শুরুতে ear-phone সবাইকে দিয়ে গেল। সেটা সিটের হাতলের সাথে সংযোগ করে, হাতলে লাগানো সুইচ অন করে বিভিন্ন চ্যানেল দেখা যায়। তার মধ্যে একটা চ্যানেলে দেখাচ্ছে প্লেন কোন পথে যাবে বা যাচ্ছে তার ম্যাপ, প্লেনের স্পীড আর বাইরের Temperature এইসব। এই সবকিছু দেখতে দেখতে আমরা ব্যাঙ্গালোর পৌঁছালাম রাত ১১টায়। বাইরে বেরিয়ে এসে যথারীতি দেখতে পেলাম আমাদের নির্দিষ্ট গাড়ি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। লাগেজ গাড়িতে তোলার সময় লক্ষ্য করলাম আমাদের সুটকেসের একটা চাকা ভাঙা। হয়তো complain করলে আর্থিক সহয়তা মিলত, কিন্তু রাতে ঝামেলা করা ঠিক হবে না মনে করে গাড়িকে বললাম যশবন্তপুরের দিকে নিয়ে যেতে। রাত ১২টা নাগাদ আমরা যশবন্তপুরে এলাম। দেখলাম চওড়া রাস্তার মাঝখান দিয়ে ব্রীজ তৈরী হচ্ছে। অন্ধকারে পরিচিত জায়গা আচমকাই অচেনা হয়ে উঠল। একটা লোকের সহয়তায় আমাদের গন্তব্যস্থল পবিত্রা লজ়ে উঠলাম। Receptionist কে ঘুম থেকে ডেকে তুলে রুম নিয়ে সটান বিছানায় চলে গেলাম।

পরদিন সকালে সোজা চলে গেলাম বাস-স্ট্যান্ডে। সেখানে সরকারি বাসের পাস কেটে নিলাম। এই পাসের মজা হল সারাদিন যত খুশি সরকারি বাস চেপে ব্যাঙ্গালোরে ঘোরা যায় বিনা বাধায়। নয়তো বিনা পাসে শহর ঘুরতে অনেক টাকা খোয়ানোর সম্ভাবনা আছে। এরপর আমরা ব্যাগ সারানোর দোকানের সন্ধানে বেরোলাম। পেয়েও গেলাম। দোকানদার জানাল ব্যাগ দেখে দাম ধার্য হবে। পৌলমী ইতিমধ্যে অভিযোগ জানাল সকালের টিফিন কিন্তু আমাদের করা হয় নি। গেলাম একটা south Indian মেস-এ। ৫/- একটা করে বড় ইডলি, সম্বর ও চাটনি সহযোগে তৃপ্তি করে খেলাম। তারপর ছোট গ্লাসে কফি-পান। এ প্রসঙ্গে বলে নেওয়া প্রয়োজন যে এলাকাটা আমরা পছন্দ করেছিলাম সে জায়গায় সাধারণ মানুষের বাস। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন কলেজ অতি নিকটে থাকার দরুণ অনেক ছাত্রছাত্রী ঐ অঞ্চলে মেস ভাড়া করে থাকে। ফলে সেখানে থাকা খাওয়া অপেক্ষাকৃত সস্তা। এরপর ব্যাগ নিয়ে এসে দোকানে দেখাতে ৩০০/- কার্য সমাধা হল। দোকানদার রাতে এসে ব্যাগ নিয়ে যেতে বলল।

স্নান করে আমরা বাসে বেরোলাম ঘুরতে। বাস ও রাস্তাঘাট সম্বন্ধে একটু বলি। কোলকাতার বাসিন্দারা বাস মাত্রেই বুঝি প্রাইভেট বাস, ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চলে। যত্রতত্র হাত দেখালেই থামে। রাস্তায় খানাখন্দে ভর্তি-এই সব। কিন্তু ব্যাঙ্গালোরের চিত্রটা সম্পূর্ণ উল্টো। লোকজন সকলেই সরকারি বাসে চড়ে। সরকারি বাসও অঢেল। নির্দিষ্ট বাসস্টপ ছাড়া বাস অন্য কোথাও দাঁড়ায় না। ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চলার কোন প্রশ্নই নেই। আর রাস্তা এত মোলায়েম যে না দেখলে বিশ্বাসই হবে না। আমাদের পরিকল্পনা ছিল মার্কেটে গিয়ে টিপু সুলতানের প্যালেস দেখে আর শিবাজীনগর ঘুরে M.G. Road আসার। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো ঘটল। মার্কেটের বাস না মেলায় প্রথমে গেলাম শিবাজীনগর। শিবাজীনগর যাওয়ার পথে চোখে পড়ল Fun World. আগে এই পথে যাতায়াতের সময় অনেকবারই দেখেছি। কিন্তু কৌতূহলের নিবৃত্তি হয়নি। তাই বাস থেকে নেমে পড়লাম। দেখলাম কোলকাতার নিক্কোপার্ক ও অ্যাকোয়াটিকার অনুকরণ। শুধু জলই জল। তাই আমরা ভেতরে না ঢুকে পরের বাস ধরে শিবাজীনগর পৌঁছালাম।

খিদেও পেয়েছিল প্রচণ্ড। ওখানেই একটা হোটেলে খাওয়া সেরে আমরা লোকাল মার্কেটের মধ্যে দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বাসস্ট্যান্ডে এলাম। সেখান থেকে বাস ধরে পৌঁছালাম মার্কেট। অনেক হেঁটে, অনেক খুঁজ়ে টিপু প্যালেসের দর্শন মিলল। ভেতরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে প্যালেস ঘুরে দেখলাম।




টিপু সুলতান প্যালেস
প্যালেসটির ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্যগুণ বর্তমান। টিপু সুলতানের বাবা হয়দার আলি এই প্রাসাদটি তৈরী করা শুরু করেছিলেন এবং টিপুসুলতান এই প্রাসাদটি সমাপ্ত করেন। প্রাসাদটি সম্পূর্ণ করতে প্রায় ১০ বছর সময় লাগে। প্রাসাদ দেখার পর আমরা গেলাম M.G. Road । এ জায়গাটি ব্যাঙ্গালোরের প্রধান কেন্দ্রস্থল। লোকজন আসে কেনাকেটার জন্য। অনেক রেস্টুরেন্ট, বইয়ের দোকান, সিনেমা হল, শপিং মল ইত্যাদি সব রয়েছে। কিছু কেনাকাটা করে আমরা Barista-য় এলাম চা খেতে। রেস্টুরেন্টটি self serviced আর খোলামেলা। কলেজ জীবনে যখন ব্যাঙ্গালোরে ছিলাম তখন এই রেস্টুরেন্টের পাশ দিয়ে যেতে যেতে খুব ইচ্ছা করত বড়লোকী কায়দায় চা খাব আর আড্ডা মারব। কিন্ত পকেটের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে মনেই থাকত। এবার ঘোরার সময় সেই স্বাদ পূর্ণ হল।






বরিস্তায় আমরা



এরপর বাস যোগে আমরা ঘরে ফিরলাম। মনে পড়ে গেল ব্যাগ আনার কথা। এবার একা বেরোলাম। রাস্তায় যেতে যেতে পুরোনো অলি গলি ছবির মত ভেসে উঠল। এদিক ওদিক উঁকি মারতেই নজরে পড়ল একটা বাঙালী মেস। রাতের খাবার সেখনেই সারলাম। মালিকের মুখ দেখে চেনা চেনা মনে হল। পরিচয় ঘটল সরাসরি। নাম টুহিন। বাঁকুড়ার ছেলে। আগে যখন দেখেছিলাম তখন ঘর ভাড়া করে ৫ বন্ধু নিয়ে থাকত এবং I.T.C-তে কাজ করত। বাবার মাত্র ২০০০০/- আর নিজের সঞ্চয়কে কাজে লাগিয়ে তখন একটা ছোট মেস খুলেছিল। এখন একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে মেস চালায়।

পরদিন সকালে উঠলাম। সেদিন কোন কাজ ছিল না। গোয়া যাওয়ার ট্রেন বিকেল ৩ টায়। সকালে এদিক ওদিক ঘুরে, ক্যাফেতে কিছু সময় কাটিয়ে, দুপুরের খাওয়া সেরে আমরা হোটেল ছাড়লাম। স্টেশন হোটেল থেকে ৫ মিনিটের পথ। অথচ অটো ভাড়া নিল ৩০/-। এ কথা নিশ্চিত, যদি ব্যাঙ্গালোর আমার চেনা শহর না হত তবে এখানেই খরচের বন্যা বয়ে যেত। স্টেশনে এসে দেখলাম ট্রেন যথারীতি দেওয়া হয়েছে। ট্রেনে বসে আছি আমাদের সীটে। সামনের সীটে এক কানাড়া ভদ্রলোক তাঁর পরিবার নিয়ে বসে আছেন। আচমকা একদল বাঙালী পরিবারের আগমন ঘটল। এসেই চেঁচিয়ে উঠল,
- “এইসা বৈঠা রহেনে সে কৈসে হোগা? এ হামারা সীট হ্যায়। যাইয়ে।”
বোঝা গেল জীবনের প্রথম ট্রেন সওয়ারী।


ট্রেনে কানাড়া দম্পতিদের সাথে
ট্রেন যথাসময়ে ছাড়ল। আস্তে আস্তে পরিচয় পর্ব শুরু হল। কানাড়া ভদ্রলোকটি একজন বিজ্ঞানী, ভাবা অ্যাটমিক রির্সাচ-এ কাজ করেন। তিনি পরিবারদের নিয়ে গোয়া যাচ্ছেন কূলদেবতার পুজো দিতে। আর বাঙালী পরিবারটি ত্রিপুরাবাসী। তাদেরও গন্তব্যস্থল গোয়া, ভ্রমনের উদ্দেশ্যে। বাঙালী হওয়ার কারণে পৌলমী তাদের সঙ্গে সহজে আলাপ জুড়ে দিল। অন্যদিকে ব্যাঙ্গালোরে থাকার দরুণ কানাড়া ভাষা রপ্ত হওয়ার কারণে সহজেই আমি বিজ্ঞানী ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ জমালাম। কথার ফাঁকে তিনি আমায় পরামর্শ দিলেন যে শেষ স্টেশন ভাস্কোয় না নেমে তার আগের স্টেশন মারগাঁও-তে নামলে আমাদের সুবিধা হবে। কোলভা বীচে সুখসাগর হোটেলে আমাদের বুকিং ছিল। মারগাঁও থেকে তার দূরত্ব ১১ কিমি। আর ভাস্কো থেকে ৪২ কিমি। কথায় কথায় সন্দীপ উন্নিকৃষ্ণানের প্রসঙ্গ উঠল। ভদ্রলোক জানালেন সন্দীপের বাব একজন বিজ্ঞানী, ইসরো-তে কাজ করেন, ইয়েলাঙ্কায় থাকেন। উনি বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের অপদার্থতা ও নির্বুদ্ধিতার প্রতি দুঃখ প্রকাশ করলেন।

আমরা চলেছি গোয়ার উদ্দেশ্যে- ভারতের কনিষ্ঠতম রাজ্যে। প্রাচীন ইতিহাসেও গোয়ার অস্তিত্ব বিদ্যমান। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যখন এখানে আসেন তখন তার আদি নামকরণ ছিল চন্দ্রপুর। এরপর যখন কদম্ব রাজবংশের অধীনস্থ হয় তখন তার নাম হয় গোবন্তপুরম। ১৪৯৪ সালে বিজাপুর সুলতান মহম্মদ আদিল শাহ গোবন্তপুরম অধিকার করে নাম দেন গোবে। এরপর পর্তুগীজ বীর যোদ্ধা আলফান্সো ডে আলবু কার্ক আদিল শাহের হাত থেকে ছিনিয়ে নেন এবং আধুনিক নামকরণ করেন- নাম দেন গোয়া। এছাড়াও সংস্কৃতে এই অঞ্চলের নাম ছিল গোমাঞ্চল আর গোয়াবাসীরা গোয়াকে চেনে গোমান্তক নামে। বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ধর্মের ও জাতির আগমণের ফলে স্থাপত্য ও সংস্কৃতিতে তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মুসলিম ও পর্তুগীজ আক্রমণের ফলে অনেক হিন্দু মন্দির ধ্বংস হয়েছে বা মসজিদ/গীর্জায় পরিণত হয়েছে। ভারত স্বাধীন হওয়ার বেশ কিছুদিন পর (১৯৬১ সালে) গোয়া ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসাবে থাকে। পরে ১৯৮৭ সালে গোয়া স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হয়। স্বাধীনোত্তর গোয়াতে আবার কিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত হিন্দু মন্দির পুণর্প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তারই একটিতে বিজ্ঞানী ভদ্রলোক পুজো দিতে চলেছেন।

রাতে ট্রেনে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা মনে রাখার মত। আমাদের ট্রেনে কোন pantry car ছিল না। তবু বিকালে লোক এল খাবারের অর্ডার নিতে। আশায় আছি আমাদের খাবার আসবে। রাত বাড়তে থাকে, কিন্তু সে লোক বেপাত্তা। অগত্যা আরেকজনকে বলায় সে জানাল পরের স্টেশন থেকে ভেজ পোলাও এনে দেবে। কিন্তু ভেজ পোলাওয়ের নামে যা এল তা খেতে প্রবৃত্তি হল না। আমাদের সামনের ত্রিপুরার পরিবারও অর্ডার পরিত্যাগ করলেন। তবে উপায়? উপায় যে হল না তা নয়। বাড়ি থেকে আমরা খাবারের জন্য আলাদা ব্যাগ বয়ে নিয়ে গেছিলাম। সেখান থেকে ছাতু এক গ্লাস খেয়ে নিলাম। তারপর মুড়ি ও চানাচুর খেলাম। এভাবে রাতটা কাটল।

সূর্যদেব তখনো চোখ মেলে তাকাননি। ব্যাগ কাঁধে, চাকা দেওয়া সুটকেস হাতে ভোর ৫:৩০ মিনিটে মারগাঁও স্টেশনে নেমে পড়লাম। রেলওয়ে ব্রীজে কোন সিঁড়ি না থাকায় মসৃণ আনত তলে ভারী সু্টকেস টানতে কোন কষ্ট হল না। স্টেশনের গায়ে ট্যাক্সি স্টান্ড ছিল। আমরা গেলাম অটো স্টান্ডে। হোটেলের নাম করতে জানাল ১২০/ টাকা লাগবে। মাথায় হাত পড়ল। তবু ভেবে শান্তি লাগল যে ট্যাক্সি চড়লে এর দ্বিগুণ ভাড়া গুণতে হত।

-সাব এক বাত বঁলু?

-হাঁ, বাতাও।

-এ সুখসাগর হোটেল আচ্ছা নেহি হ্যায়। লেড়কি লোগোকা চক্কর চলতা হ্যায়। আপ জিসকো ভি পুছো ও এইসা হি বাতায় গা।

অটোওয়ালার কথা শুনে পৌলমীর চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। হাত শক্ত করে চেপে ধরল। বুঝলাম বেশ ঘাবড়ে গেছে।

-ঠিক হ্যায়, আপ লে চল। আগার গড়বড় হোগা তো আপকা মদত লেঙ্গে।

অটোওয়ালাকে এই বলে সামাল দিলাম। আর পৌলমীকে বললাম ব্যাটার কমিশন নেওয়ার মতলব, তাই এরকম করছে। কিন্তু আমার কথা ও সম্পূর্ণ মেনে নিতে পারল না। ট্রাভেল এজেন্সির বাপ বাপান্ত করতে লাগল। মন্টা তার অশান্তিতে ভরে গেল। হোটেল পৌঁছে দেখলাম সেই হতচ্ছাড়া মন বিষিয়ে তোলার সবরকম চেষ্টায় রত। অগত্যা তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়ে আগে ভাগালাম। তারপর ফোন করে ঘুমন্ত Receptionist কে ডেকে তুললাম। সে জানাল দুপুর ১২টার আগে ঘর মিলবে না। সাতসকালে তাকে ঘুম থেকে তুলেছি বলে তার মাথা গরম। অন্যদিকে অটোওয়ালার দুষ্টুবুদ্ধিতে পৌলমীর মানসিক অশান্তির জেরে আমিও কিছুটা তিতিবিরক্ত ছিলাম। ফলে বয়টির সাথে বাদানুবাদ অবশম্ভাবী ছিল। তাই নিজেকে সংযত করে তাকে বোঝালাম লাগেজ রিসেপশন-এ আমরা বাইরে যাচ্ছি ঘুরতে। ইতিমধ্যে সে যেন মালিককে ফোনে জেনে নেয় তার কি করণীয়। বয়টি সে কথাতে রাজী হয়ে গেল।

আমরা ঘুরতে বেরোলাম। হোটেলের সামনের রাস্তা ধরে ডানদিকের অলিগলি বেয়ে যত এগোতে থাকলাম ততই মাটির ঘর-দোর চোখে পড়তে লাগল। সমুদ্রের দেখা মেলে না।

-এর থেকে মন্দারমণির রাস্তা অনেক সুন্দর।

পৌলমীর উক্তি নীরবে হজম করলাম। কিন্তু রাস্তা একজায়গায় বাড়ি ঘর-দোরের সামনে এসে আটকে গেল। সমুদ্রের দেখা মিলল না। তার বদলে বাড়ির সামনে বসে থাকা কুকুরের সাক্ষাত ঘটল। এত ভোরে অচেনা, অপরিচিত লোক দেখে সে-যে মোটেই খুশি হয় নি সেটা তার ভাষা ও ব্যবহারে প্রকাশ পেল। ফলে আমরা ফিরে আসতে উদ্যত হলাম। চলে আসার সময় দেখি সেই কুকুরটা আমাদের তাড়াতে কিছুটা এগিয়ে এসেছে। আমরা হঠাত থমকে দাঁড়ালাম। কুকুরটাও আমাদের দিকে সন্দিগ্ধ চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তাকে কাছে আসার জন্য আহ্বান করলাম। সে বুঝল কিনা জানি না। তার দিকে একটু এগোতেই ভৌ ভৌ রবে সে উলটো দিকে চোঁ-চা দৌড় মারল। আমরা হাসতে হাসতে আবার হাঁটতে লাগলাম। পথে আরেকজনের হোটেলের লোকের সাথে দেখা হল। সবে ঘুম থেকে উঠেছে। মুখ ধুচ্ছিল। সে দেখিয়ে দিল কোলভা বীচের পথ। তার নির্দেশিত পথে গিয়ে দেখলাম হোটেল থেকে বীচের দূরত্ব খুব বেশি হলে ৩ মিনিট।

ঘড়িতে তখন ৭টা ছুঁই ছুঁই। সূর্যদেব ঘুমচোখ মেলে সবে উঠেছেন। মাথার উপরে সুবিশাল নীলাকাশ। জলে ভেজা বালি তীরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। আমরা এসেছি আরব সাগরের সান্নিধ্যে। আমাদের সামনে সমুদ্রের অসীম বিস্তৃত জলরাশি। দূরের জলের রঙ গাঢ় সবুজ, কাছের জলের রঙ নীল। হাল্কা হাল্কা ঢেউ আমাদের দিকে আসছে। ফেনাময় কোন কোন ঢেউ পা ছুঁইয়ে আহ্বান করছে। ঠান্ডার কোন বালাই নেই। এখানকার সমুদ্র খুব শান্ত। তীর দিয়ে সারিবদ্ধ নারকেল গাছ। হাতে গোনা কয়েকজন প্রাতঃ ভ্রমণ সারতে এসেছে। এইরকম নয়নভোলা রূপের কে না তারিফ করবে? পৌলমীর রাগ অনেকটা পড়ে গেল।

সাড়ে সাতটার সময় আমরা বাইরে থেকে চা পান করে হোটেলে ফিরলাম। বয়কে জিজ্ঞাসা করলাম মালিকের সাথে কথা হয়েছে কিনা। সে জানাল হয়েছে। সে আমাদের জন্য দোতলায় রুমের ব্যবস্থা করে দিল।



মনমোহিনী গোয়া




হোটেল সুখসাগর


-ধুত, এটা একটা হোটেল হয়েছে? বাথরুমটার কি ছিরি! এর থেকে ব্যাঙ্গালোরের হোটেল অনেক ভাল ছিল।

রুম দেখে পৌলমী তার মতামত ব্যক্ত করল। বুঝলাম পরিস্থিতি অনুকূলে নেই। টিভি চালিয়ে এদিক সেদিক দেখতে দেখতে জানিয়ে দিল যে তার ইচ্ছা গোয়ায় যতদিন থাকবে ততদিন টিভি দেখেই কাটিয়ে দেবে। কোথাও ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা তার নেই। অগত্যা আমি একা বেরিয়ে পড়লাম এদিক সেদিক ঘুরে জায়গাটা চিনে নেওয়ার জন্য আর A.T.M থেকে টাকা তোলার জন্য। এদিক সেদিক ঘুরে যে তথ্য পেলাম তা হল কোলভা বীচ হতেই North Goa /South Goa ট্যুর হয়। বাস তো আছেই, এছাড়াও ট্যাক্সি, বাইক, বাই-সাইকেল সবকিছুই ভাড়ায় মেলে। জিজ্ঞাসা করলাম ২৪ তারিখ Christmas celebration কোথাও হবে কিনা। জবাব এল- না। এই উত্তর আমার কাছে প্রত্যাশিত ছিল। কারণ, ২৬/১১ র পর গোয়া সরকার অত্যন্ত সতর্ক ছিল এ ব্যাপারে। কাগজে পড়ে এসেছিলাম যে বীচের ধারে কোন অনুষ্ঠান হবে না। সকলকেই তা মানতে হচ্ছে। অনেক বিদেশী গোয়া আসা cancel করেছেন। তাই গোয়ার বাজার এবছর মন্দা।

A.T.M থেকে টাকা তুলে ঘরে এলাম। গিন্নী তো নাছোড়বান্দা, ঘর থেকে কিছুতেই বেরোবে না। অনেক বুঝিয়ে ঘর থেকে বের করানো গেল। সোজা চলে গেলাম সমুদ্রের ধারে। বেলা বেড়েছে, রোদও ভীষন। এখন সমুদ্রের জলের পরিবর্তন লক্ষণীয়। তখন গাঢ় সবুজ ছিল, এখন গাঢ় নীল। লোকজনের ভিড়ও বেড়েছে। বীচের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে গিয়ে দুই তিনজন ছেলে এসে জিজ্ঞাসা করতে লাগল স্পীড বোট, প্যারাশুট রাইডিং, মোটর রাইডিং করব কিনা। না বলতে বলতে বিরক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তবু মনে হল অন্যবারের অপেক্ষা এবারের লোকসমাগম অনেক কম।





বীচের ধারে রেস্টুরেণ্ট


বিদেশীদের ভিড় যথেষ্ট অর্থেই কম। যারা বীচে এসেছিল, বিশেষ করে বিদেশীরা, বলা বাহুল্য, সুইমিং কস্টিউমে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিল। আমরাও সেই মতকে গ্রহন করেছিলাম। সমুদ্রসৌন্দর্যকে আস্বাদন করতে নিভারবন হয়ে যত না মজা, তার থেকে অন্য কিছুতে সে মজা আসে না। অনেকক্ষন বীচে বসে, বীচের ধারে এক রেস্তঁরা থেকে খাওয়াদাওয়া সেরে ঘরে ফিরলাম।

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল বিকাল ৩টা নাগাদ, স্নান সেরে বেরিয়ে পড়লাম। হোটেল থেকে বেরিয়ে আবিষ্কার করলাম শুকনো তাল, নারকেল পাতার ছাওনি দেওয়া বাঙালী রেস্টুরেন্ট- হোটেল বাবুমশাই। মালিক- পরিমলদা। ভদ্রলোক ১৬ বছর ধরে গোয়ায় আছেন। বেশ আলাপ জমে উঠল। জন্ম শান্তিপুরে, পেটের ভাত জোগানোর তাগিদে ইস্রায়েল ও দুবাই ঘোরা। হোটেলে শেফ –এর কাজ করতেন। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে হোটেল খুলেছেন। এইসময় পোলমী সাহস করে জিজ্ঞাসা করে বসল,

- আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
- কি?
- না, সকালে আমরা যে অটো করে এসেছিলাম সেই অটোওয়ালা বলেছিল যে এই হোটেলটা খারাপ। মেয়েদের নিয়ে কারবার করে। সত্যি কি তাই?
- না, না, এটা খুব ভালো হোটেল। এই হোটেলের মালিক এইসব পছন্দ করেন না।

শুনে ওর মনের খচখচানি দূর হল। আমিও স্বস্তি পেলাম। সুযোগ বুঝে বললাম,

- পরিমল দা, 24th night celebration এর একটা ব্যবস্থা করে দেন না।
- এখানে তো এবার কোথাও তা হচ্ছে না।
- আরে কাগজ়ে দেখলাম, Benolim নামে এক জায়গায় হচ্ছে। গাড়ির ব্যবস্থা করে দিন একটু।
- ঠিক আছে। করে দেব।

-ধুর, অত রাতে বাইরে থাকতে হবে না।- পৌলমী তার আপত্তি ব্যক্ত করল।

-কেন? -আমি আবাক হলাম।

- কিছু মনে করবেন না, এখানে কোন মহিলা শুধুমাত্র অন্তর্বাস পরে ঘুরে বেড়ায় বা সেটা না-ও পরে থাকে, তবুও কেঊ কিছু বলবে না। আর বললে ১০০ ডায়াল করবেন, পুলিশ এসে তার অবস্থা খারাপ করে ছেড়ে দেবে।

আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পরিমল দা যে জবাবটা দিলেন তাতে ওর মনের সকল অশান্তি দূর হল। বিকালের চা পর্ব সেখানে সেরে এদিক সেদিক ঘুরে, কিছু জিনিস কিনে ঘরে ফিরলাম।

ঘরে বেশ খানিক্ষণ থেকে আবার বেরোলাম। বীচের ধারেই ঘুরছিলাম। হঠাৎ
গানের গলা ও তালে তালে নাচের মুর্ছনা ভেসে এল। দেখলাম, বীচের উপর এক
রেস্টুরেন্টে 24th night celebration হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে নিলাম দূরে কোথাও
যাওয়ার থেকে বীচের ধারে সময় কাটানোই ভাল। সেইমত পরিমলদাকে মানা করে আবার রেস্টুরেন্টায় এলাম। তখন বোধহয় Break ছিল। গান বাজনা থেমে ছিল। আমরা বীচ ধরে কিছুদূর হাঁটলাম। ফিরে এসে দেখি আবার গান হচ্ছে। বালি ভেঙে রেস্টুরেন্টে ঢুকতে যাব, এমনসময় –

-রাজকুমারদা, ও রাজকুমারদা,

দূর থেকে দেখি বালি ভেঙে অন্ধকার ভেদ করে আফ্রিকা থেকে আগত এক ব্যক্তি খাস বাংলায় আমার নাম নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে আসতে ঠাহর হল এ আমাদের নিক্কো কোম্পানির সায়ন্তন বাবু। ও আমাকে জানিয়েছিল গোয়ায় ঘুরতে যাওয়ার কথা। তবে এইভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। প্রাথমিক পরিচয় পর্ব সারা হল।

-গত দুইদিন ধরে আমরা ক্লান্ত। তাই আজ হোটেলেই বিশ্রাম নিচ্ছি। খুব ভালো হোটেল, কোনো অসুবিধা নেই। সকালে সুইমিং পুলে পোলো খেললাম। পারলে আমাদের হোটেলে ঘুরে যেও। বৌদি, আপনিও আসতে পারেন।

কথা বলতে বলতে দেখলাম ঝোড়ো হাওয়ায় শক্ত গাছগুলো যেমন নুয়ে পড়ে, তেমনি সায়ন্তন বাবু মাঝে মাঝে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে পরক্ষণেই সোজা হয়ে উঠছিলেন। বুঝলাম, সমুদ্রের হাওয়ায় পিপাসা একটু বেড়ে গেছে। তাই ওর কথায় নীরব সম্মতি জানিয়ে আমরা রেস্টুরেন্টে এলাম। কিছুক্ষন পর আমরাও নেমে পড়লাম নাচের আসরে। আমাদের নাচ দেখতে সায়ন্তন বাবুও এসে হাজির।

-রাজকুমারদা, তোমায় এভাবে কোনোদিন দেখিনি। নাচো রাজকুমারদা, নাচো।

ওর প্রশংসায় আমি বিগলিত হয়ে পড়লাম। নাচতে লাগলাম। তবে ওর মনের অবস্থা বেশ ঠাহর পাচ্ছিলাম। এক কবিতার লাইন মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল-

নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস

সুখে আছে ওপার আমারি বিশ্বাস।।






নাচের আসরে সায়ন্তনের আবির্ভাব



রাত ১টা নাগাদ আমাদের হুল্লোড় থামল। তাও জোর করে থামানো হল। জানা গেল বাইরে পুলিশ টহল দিচ্ছে। তাই যে কোন সময় রেড হতে পারে। আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে বাবুমশাই-এ খাওয়া দাওয়া সেরে রাত ২টোয় ঘরে ফিরলাম। পরদিন সকাল সকাল উঠতে হবে।

-এই ঝিঙ্কি, উঠবে না?

-হুম, কটা বাজে?

-৯টা, ঘুরতে যাবে না?

পরদিন সকালে উঠেই দিন শুরু হল আমাদের এই কথোপকথনের মধ্য দিয়ে। পৌলমী তড়াক করে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে বলল,
-তুমি তাড়াতাড়ি করে বাস বুক করো। আমি রেডি হয়ে আসছি।

কিন্ত বাস-স্ট্যাণ্ডে গিয়ে দেখি যথারীতি টুরিস্ট বাস চলে গেছে। কি করব ভাবছি। দেখি লোকাল বাস দাঁড়িয়ে আছে। তাতে করে চলে গেলাম মাঁরগাঁও। উদ্দেশ্য বাসে বাসে গোয়া ঘোরার। মাঁরগাঁও পৌঁছে লোকমুখে পাউলো ট্রাভেলসে গেলাম। জানলাম North Goa Tour- এর বাস চোলে গেছে। South Goa Tour- এর Ac বাস ছাড়ার মুখে। সানন্দে বাসে উঠে পড়লাম।





পর্তুগীজ মিউজিয়াম


প্রথমে গেলাম পর্তুগীজ মিউজিয়ামে। খাওয়া দাওয়া কিছুই হয় নি। মিউজিয়ামের কাছেই একটা স্ন্যাক্সের দোকানে বড়াপাও (পাঁওরুটির মধ্যে আলুর বড়া) খেয়ে সকালের টিফিন সারলাম। তারপর গাইড সহযোগে মিউজিয়াম দেখতে গেলাম।


পর্তুগীজরা যখন প্রথম গোয়ায় আসে তখন তাদের ভাষা, সংস্কৃতি আদান প্রদানের জন্য ৩৫জন হিন্দু অধিবাসীকে বেছে নিয়ে নিজ ভাষা, স্থাপত্য ও শিক্ষায় দীক্ষিত করে তোলে, ঘর-বাড়ি বানিয়ে দেয়। সেই প্রথম ৩৫জন অধিবাসীর মধ্যে ৮ জন বর্তমান। তাঁদের মধ্যে একজন মিউজিয়ামটি গড়ে তোলেন। নানা জিনিস দেখার ছিল। তার মধ্যে দুই একটি উল্লেখযোগ্য-

তখনকার দিনে দরজা-জানালায় কোন কব্জা থাকত না। যখন কেউ বাথরুমে যেত, তখন কব্জাবিহীন দরজা আড়াল করা হত। যদি কেউ অজান্তে সেইসময়ে দরজায় ধাক্কা দিত, দরজার আঘাতে ভেতরে থাকা ব্যক্তির মৃত্যু ঘটা অসম্ভব ছিল না। কিন্ত আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বাস্তবে তা ঘটত না। কারণ বাথরুমে কেউ গেলে বাথরুমের পাশের ছোট খোপে প্রদীপ জ্বালিয়ে যেত। আবার বাইরে এলে প্রদীপ নিভিয়ে দিত।

সে সময় ওজনের জন্য কোন একক আবিষ্কার না হওয়া স্বত্তেও বিভিন্ন মাপের কাঠের পাত্র সহযোগে পর্তুগীজরা নির্দিষ্ট ওজনের জিনিস সরবরাহ করত। অর্থাৎ ৫কিলো গম চাইতে হলে বিভিন্ন মাপের পাত্রের সাহায্যে ঐ ওজনের সমপরিমাণ গম দেওয়া হত।

এছাড়া ছিল ফাইলপত্র সহ গহনা ইত্যাদি ব্যবহার করার টেবিল। একটা ঘরকে কখনো বৈঠকখানা, আলোচনা করার ঘর, কখনো বিবাহের আসরে নাচের ঘর হিসাবে ব্যবহার করা দেখার মত।

এরপর গেলাম সান্তাদূর্গা মন্দিরে। যেটা শাহুজী (শিবাজীর পৌত্র) ১৭৩২ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরে পর্তুগীজ স্থপতি ও হিন্দু ভাষ্কর্যের সংমিশ্রণ লক্ষণীয়।

গেলাম মঙ্গেশ্বর মন্দিরে। এটি বাবা শিবের নামে নিবেদিত। আগে মন্দিরটি ভাস্কোয় ছিল। পর্তুগীজ আক্রমণের পর সেটি স্থানান্তরিত হয়। লতা মঙ্গেশ্বরের কূলদেবতা হলেন ভগবান মঙ্গেশ। তাই বছরে লতাজী একবার এসে এখানে বিনা পয়সায় গান শুনিয়ে যান।




সান্তাদূর্গা মন্দির



এবার এলাম Bom Jesus Church দেখতে। এই চার্চে যীশুখ্রীষ্টের বাচ্ছাবেলাকে তুলে ধরা হয়েছে। এই চার্চে আছে সেণ্ট জেভিয়ার্স ফ্রান্সিকোর সমাধি। জীবনের শেষদিকে তিনি ভারতে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। চীন থেকে জাহাজপথে ফেরার সময় তাঁর মৃত্যু ঘটলে চীনে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। দুইবছর পর সেণ্ট উপাধি দেওয়ার












যীশুর শিশুকাল






সেণ্ট ফ্রান্সিস্কোর সমাধি



কারণে যখন সমাধি বাইরে আনা হয়, দেখা যায় তাঁর শরীর অবিকৃত আছে। পরে রোমান পোপের ইচ্ছা অনুসারে তাঁর শরীরের থেকে একটি হাত কেটে সেখানে সমাধিস্থ করা হয় এবং শরীরের বাকি অংশ Bom Jesus Church- এ এনে সমাধিস্থ করা হয়। প্রতি দশ বছর অন্তর তাঁর শরীর সর্বসমক্ষে আনা হয়। দেখা হয় শরীরে কোন পচন ধরেছে কিনা। অলৌকিক যেটা তা হল আজো তাঁর শরীর অবিকৃত আছে।

যে কোন ধার্মিক এই অলৌকিকতাকে একবাক্যে মেনে নেবেন। কিন্ত যুক্তিবাদী মানুষের মনে প্রথমেই প্রশ্ন জাগবে যদি তাঁর শরীর চির অবিকৃত তবে তাঁর কফিন বন্দী দেহ সকলের দৃষ্টির নাগালের বাইরে রাখা হল? কেন প্রতি দশ বছর অন্তর তাঁর শরীর সর্বসম্মুখে আনা হয়, কেন প্রতিদিন নয়? যদি কোন ওষুধপত্র সহযোগে তাঁর শরীর অবিকৃত রাখা হয় তবে আশ্চর্যের কিছু নেই।



রহস্যে ভরা ফ্রান্সিস্কোর অলৌকিক হাত




এইসব চিন্তাভাবনা নিয়ে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সারলাম। তারপর গেলাম Dona Poula । ডোনা শব্দের অর্থ ম্যাডাম বা মহাশয়া। এটি একটি পর্তুগীজ শব্দ। ম্যাডাম পাওলা ছিলেন পর্তুগীজ ভাইসরয়ের কন্যা। তিনি ভারতে এসে গোয়ার এক মৎসজীবীর প্রেমে পড়ে যান। কিন্ত তাদের এই প্রেম সমাজ মেনে নেয় না





ডোনা পাওলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

ফলে তাঁরা দুইজনে একসঙ্গে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। পরবর্তীকালে সেই জায়গার নাম হয় ডোনা পাওলা। তাঁদের এই প্রেম কাহিনীকে নির্ভর করে হিন্দি সিনেমা ববি তৈরী হয়।


ডোনা পাওলায় আমরা






ডোনা পাওলা থেকে আমাদের শেষ গন্তব্যস্থল ছিল কোলভা বীচ। সবাই যখন কোল্ভা বীচে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত, আমরা তখন হোটেলের পথে। ঘরে ফিরে ফ্রেস হয়ে সন্ধ্যার সময় বেরোলাম সমুদ্রের হাওয়া খেতে।




আজ ২৬ তারিখ। সকালে ঠিক সময়ে উঠে পড়েছিলাম। তাড়াতাড়ি করে বীচের ধারে বাস ধরতে গিয়ে শুনলাম বাস আগে থাক্তেই ভর্তি হয়ে গেছে। তবে বাসের মালিক অন্য এক মিনিবাসে আমাদের ব্যবস্থা করে দিলেন। বাসের সাম্নের দিকে আমাদের জায়গা হল। এক বুড়ো ভদ্রলোককে পৌলমীর ভয় হল এই ভেবে যে আমাদের যাত্রায় বৃদ্ধ যাত্রীর সংখ্যা বেশি হবে কিনা।সরাসরি ঘোষনা করল-বুড়োবুড়ি গেলে কিন্তু আমরা যাব না। কিন্তু বাস্তবে আমাদের নিয়ে পাঁচজন দম্পতি আর ছ্য়-সাতজন যুবকদের নিয়ে বাস ছাড়ল।


আগুডা ফোর্টে পৌলমী


পথে যেতে যেতে সকলের সঙ্গে পরিচয় হল। যুবকরা রাজস্থানের জয়পুরের বাসিন্দা। আর তিন দম্পতি হিমাচলের কাল্কা থেকে আগত। আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খন্ড থেকে এক দম্পতি এসেছে।

আগুডা ফোর্টটি পর্তুগীজদের জাহাজ চলাচলের জন্য জলসংরক্ষণ ধারক স্থান। এতে ২৬,৭৬৩ গ্যালন জল ধরে। এছাড়া এখানে বারুদ রাখার বন্দোবস্ত আছে। একটি লাইট হাউস আছে।



ভাগাডোরে স্পা


এরপর আমরা চললাম ভাগাডোর বীচের উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌলমী নজরে আনল একজন স্পা করছেন। এক ভদ্রমহিলাকে বালি দিয়ে মুখটুকু বাদ দিয়ে সারা শরীর ঢেকে দেওয়া হয়েছে।



ভাগাডোরে আমরা



ক্যালাঙ্গুটে আমি




আঞ্জুনা বীচে গেলাম না। তার বদলে ক্যালাঙ্গুট বীচে সময় দেওয়া মনস্থ করলাম। এই বীচের লোক সমাগম দেখে পৌলমীর পুরীর সমুদ্রের সাথে তুলনা করল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, গোয়ার অন্যান্য সকল বীচ অপেক্ষা বিস্তৃতিতে সবচেয়ে বড়।

ক্যালাঙ্গুট বীচ ঘুরে আমরা চললাম মাণ্ডবী নদীবক্ষে লঞ্চ ভ্রমনের উদ্দেশ্যে। ডেকের


স্বস্তিকায় আমরা


স্বস্তিকার ডেকে পর্তুগীজ অনুষ্ঠান

জয়পরের বন্ধুদের সাথে


কালকার তিন দম্পতি


উপর পর্তুগীজ লোকসঙ্গীত, নাচ-গান ইত্যাদি চলে। সঙ্গে দর্শকদের আহ্বান হয় এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করতে। একঘণ্টা অতিক্রম করে লঞ্চটি আবার ঘাটে ফেরে। আমরা যে লঞ্চে উঠেছিলাম তার নাম স্বস্তিকা। লঞ্চের দ্বিতীয় তলায় নাছের জন্য ডিস্কো ছিল এবং এছাড়াও পানীয় সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল। লোকজন পানীয় পানে এত মত্ত ছিল যে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন তাদের মাথায় ছিল না। ফলে অনুষ্ঠান তেমনভাবে জমে ওঠে নি। ডেকের উপর বসে পৌলমী হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠল,

- এরকম অনুষ্ঠান আমাদের ইছামতী নদীবুকে করা যায় কিন্ত। লঞ্চ করে ইছামতী নদীতে একঘণ্টা ঘোরানো হবে, আর অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু আমাদের সংস্কৃতি অনুকরণে হবে। ভাল টুরিস্ট হবে, অনেক বেকার লোকের কর্মসংস্থান হবে।

লঞ্চ ভ্রমন শেষ হলে আমরা ফিরে এলাম গাড়ীতে। লঞ্চে ওঠার আগে সকলের সাথে পরিচয় হয়ে গেছিল। কালকা থেকে এসেছিল তিন বন্ধু- দীপক, বিক্রম আর একজন যার নাম এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না (ছবিতে আমার ডানপাশে রয়েছে নাম না জানা বন্ধু, বাঁয়ে দীপক ও তার স্ত্রী, মাঝে নাম না জানা বন্ধুর স্ত্রী, তার পাশে সস্ত্রীক বিক্রম)। দীপকের আপেলের ব্যবসা। বিক্রমের মোবাইল এবং অন্যজনের কসমেটিক্সের ব্যবসা। ঝাড়খণ্ড থেকে যে দম্পতি এসেছিল তারা সকলের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলছিল (ছবিতে “ডেকের উপর পর্তুগীজ অনুষ্ঠান”-একদম ডানদিকে মাথায় ফেট্টি বেঁধে ভিডিও ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে)। এছাড়া রাজস্থান থেকে এসেছিল সানি বর্ধান ও তার বন্ধুরা (ছবিতে সাদা শার্ট পরিহিত ছেলেটির পিছনে সানি)। সানির মত উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত ছেলে খুব কমই দেখেছি। সবকিছুতেই প্রবল উৎসাহ। অয়ামাদের ট্যুরকে ও একাই মাতিয়ে রেখেছিল। গাড়িতে ফিরেই জানিয়ে দিল যে লঞ্চে নেচে তার হাল অত্যন্ত খারাপ। কিন্ত গাড়িতে যে মাত্রই গান আরম্ভ হল তখনই সে আবার নেচে উঠল। নাচের হিল্লোল জেগে উঠল সবার মধ্যে। মেয়েরাও বাদ গেল না। এমনকি ড্রাইভারও হোটেলে এসে গাড়ি থামিয়ে নামার আগে নেচে নিল খানিকটা। স্বীকার করে নিল যে এরকম গ্রুপ খুব কমই মেলে। এভাবে আমাদের N. Goa tour শেষ হল।

২৭ তারিখ। আজ বিশ্রামের দিন। সকালে ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে গেলাম সমুদ্রে স্নান করতে। সারাদিন ধরে সমুদ্র সৌন্দর্য উপভোগ করাই আমরা স্থির করলাম। এখানে সমুদ্র খুব একটা অশান্ত নয়। দুই এক বাঙালী পরিবারের আনাগোনা দেখা গেল। সালোয়ার কামিজে কেউ কেউ স্নানে নেমেছেন। তবে ভিজে




কোল্ভায় সমুদ্র স্নানে





জামাকাপড়ে তাঁরা যখন উপরে উঠে আসছিলেন, তখন বেশ বিসদৃশ লাগছিল। মনে হচ্ছিল গোয়ার এই পরিবেশে সমুদ্র পোশাকে স্নান করাটাই বেশি পরিতৃপ্তির। যেখানে কেউ কিছু বলার নেই, সেখানে স্বাধীনভাবে নিজেকে মেলে ধরাটাই অনেক আনন্দের। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ট্যুরিস্টদের প্রতি গোয়া সরকারের তীক্ষ্ণ নজর লক্ষ করার মত। সমুদ্রের তীর বরাবর লাইফ গার্ড সবসময় বর্তমান। তারা পতাকা লাগিয়ে Safe zone ও Danger zone – এ ভাগ করে দিচ্ছে। স্নানার্থীদের অনুরোধ করছে Safe zone এ স্নান করতে।

স্নান পর্ব সেরে আমরা রেস্টুরেণ্টে গেলাম খেতে। চোখের সামনে সমুদ্রকে দেখতে লাগলাম খেতে খেতে। রোদ যত বাড়ছে, সমুদ্রের নীল রঙ তত ফিঁকে হচ্ছে। বেশ ভাল লাগছিল। আমার বাঁদিকের হাল্কা নীল রঙের জল, ডানদিকে গাঢ় নীল রঙের জল, মাঝখানে দুই রঙের সংমিশ্রণ। এইসময় একটা কাণ্ড হল। দূর থেকে দেখলাম এক রুশ ছেলে তার বোনকে নিয়ে রেস্টুরেণ্টে এল। ছেলেটার বয়স বারো কি তেরো হবে। মেয়েটা আরো ছোট। হোটেল বয় তাকে খাবার অফার করলে সে না করল। এরপর সে বোনকে নিয়ে সমুদ্রের তীর ধরে মেন রোডের দিকে চলে গেল। অনেক্ষন পর ওদের মাকে দেখলাম হন্তদন্ত হয়ে সী বীচের উপর দিয়ে হাঁটতে। আমাদের ইসারাতে হোটেল বয় নিজে থেকে গিয়ে ভদ্রমহিলাকে তাঁর সন্তানদের গন্তব্যপথের হদিশ দিল। কিছুক্ষন পরে তিনি তাঁর সন্তানদের দেখা পেলেন। কিন্ত এতটুকু তিরষ্কার বা মারধোর করলেন না। অনুভব করলাম যে তিনি শুধু বোঝালেন তাঁর উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠার কথা। আরো বুঝলাম, এদের সঙ্গে আমাদের তফাৎ কোথায়। আমাদের ক্ষেত্রে বাচ্চাগুলো কোথাও চলে গেলে মেরে ধরে বকে শেষ করতাম। তাদের ভেতরের আত্মবিশ্বাস অচিরেই নষ্ট হয়ে যেত। যেটা হয় না ভিনদেশী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। খাওয়া পর্ব শেষ করে হোটেলে চলে এলাম।

বেড়াতে এসে আলাপ হওয়া অনেকগুলো চরিত্র আজ অনন্ত ভাবনার মাঝে উঁকিঝুঁকি মারছে। তারমধ্যে আছে বাবুমশাইয়ের মালিক পরিমলদা। ভদ্রলোককে দেখে প্রথমে ভালোই লেগেছিল। গোয়ায় এসে বাঙালী লোকের সাথে খাস বাঙলায় গল্প করতে কারই না ভাল লাগে। কিন্ত পরে দেখলাম বাঙালী সহানুভূতিকে নির্ভর করে বাঙালী খাবারের লোভ দেখিয়ে চড়া দামে (সকালের ব্রেকফাস্ট এক প্লেট ডিম পাঁউরুটির টোস্ট চা সহ দুজনের ১০০/) ব্যবসা চালাচ্ছে, নিরীহ মানুষগুলোকে জবাই করছে, তখন তার সহানুভূতি যে ব্যবসাকেন্দ্রিক তা বেশ বোধগম্য হল। অগত্যা আমরা অন্য রেস্টুরেণ্ট এবং কখনো কখনো আমাদের নিজস্ব সম্বল থেকে খাওয়া দাওয়া সারছিলাম।

পরিমলদার দোকানেই পরিচয় হল শুভ নামে একটি ছেলের সাথে। ছেলেটার দমদমে বাড়ি। মা নেই, দাদা ছিল- মারা গেছে। বোম্বে এসেছিল কাজের খোঁজে-হোটেলের কাজ। বড় একটা হোটেলে কাজ করত। ম্যানেজারের সাথে কাজের ব্যাপারে ঝামেলা
হওয়ায় কাজ ছেড়ে পরিমলদার দোকানে আশ্রয় নিয়েছে। ব্যাঙ্গালোরে হোটেল ম্যানেজমেণ্টে ডিপ্লোমা করেছে নিজের খরচাতেই। ইচ্ছে আছে বাইরের দেশে চাকরি করা।


আরেকজনের সাথে আলাপ হল। তার নাম অভী, সিভিল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। সাইটের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মুম্বই থেকে গোয়ায় সোজা পরিমলদার দোকানে এসে হাজির। বাবার দুই বিয়ে, পিসীর কাছে মানুষ। বাড়ি কম যায়, কিছুদিনের মধ্যে আবার মুম্বই যাবে।


বিকেলে আবার সমুদ্রে ঘুরতে বেরনো। সন্ধার সময় সানি ফোনে জানাল N. Goa tour এর সকলে একসাথে হবে রাতে। আমাদেরও নিমন্ত্রন আছে। পৌলমীর মন খারাপ হয়ে গেল। শেষদিন সমুদ্র ছেড়ে কোথাও তার যেতে ভাল লাগছে না। তবু জোর করে গেলাম। ভালই কাটল রাতটা। পরিচয়টা আরো জমে উঠল।




২৮তারিখ। আজ গোয়াকে বিদায় জানানোর দিন। সকালবেলায় সানি এসে হাজির। সত্যি ভালো লাগল। সম্পর্কটা এত আন্তরিক হয়ে উঠেছে দেখে। আমরা লোকাল বাস চেপে স্টেশনে নামলাম। চমক যে আমাদের পিছু ছাড়েনি অনুভব করলাম একটু পরেই। দুপুরের খাওয়া সারলাম একটা ভেজ হোটেলে। ব্যয় হল মাত্র ৭৫/। খাওয়া পর্ব সেরে দুপুরের ট্রেন ধরলাম। ছেড়ে গেলাম গোয়া। আমাদের গন্তব্যস্থল মুম্বই।



বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়




অনেক টানেল পেরিয়ে পাহাড়ের ধার ঘেঁষে রাত সাড়ে এগারোটায় মুম্বই এসে পৌঁছালাম। ভয় ছিল অত রাতে খাবার মিলবে কিনা। ক্লোক রুমে ব্যাগ পত্তর রেখে রাত বারোটায় বেরিয়ে একটা হোটেল দেখলাম তখনো বন্ধ হয় নি। তাড়াতাড়ি খেয়ে স্টেশনে এলাম। ভাবলাম রিটায়ার রুমে রাত কাটাবো। কিন্ত রুমগুলো এত ছোট, এত মানুষের ভিড় যে প্রবৃত্তি হল না সেখানে রাত কাটানোর। অগত্যা স্টেশনে এসে বসার বেঞ্চিতে একজনের কোলে একজন মাথা দিয়ে কোনক্রমে রাত কাটালাম। ঘুম হল নামমাত্র। রাত তিনটায় দুজনে উঠে পড়লাম। ঘুরতে লাগলাম এদিক ওদিক। এই সেই ভিটি স্টেশন বা ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস। এখানেই কাসভ তার সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে হামলা চালিয়েছিল। চারিদিকে পুলিশ চৌকি, জায়গায় জায়গায় শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ব্যানার টাঙানো। তবে পুলিশ চৌকি থাকলেও পুলিশদের গা ছাড়া ভাব। এতবড় কাণ্ডের পরও এরকম গা ছাড়া ভাব কল্পনাতীত। সকাল ছটায় গীতাঞ্জলী এক্সপ্রেসে উঠে সটান শুয়ে পড়লাম। মুম্বই কখন ছাড়লাম টের পাই নি।


কিছু বিশেষ তথ্য

১। আমরা আমাদের প্লেনের ভাড়া ও যাত্রাপথ নির্ধারণ করেছিলাম www.makemytrip.com থেকে।

২। ব্যাঙ্গলোরে সরকারি বাসপাস পাওয়া যায় মাত্র ৩০টাকার বিনিময়ে। সুবিধা এই শহরের মধ্যে যত খুশি বাস চড়া যায় ওই পাস দেখিয়ে।

৩। যশবন্তপুরে হোটেলের কাছে বাঙালী মেসে খাওয়ায় খাওয়া খরচ অনেক কম হয়েছিল। একবেলার খাওয়া দুজনের লেগেছিল ৫৪/। তাছাড়া যেহেতু যশবন্তপুর ব্যাঙ্গালোর থেকে একটু দূরে, হোটেল ভাড়াও কম পড়েছিল। সাধারণত হোটেল ভাড়া প্রতিদিন ৬০০-৭৫০/ হয়, সেখানে আমাদের লেগেছিল ৩০০/ প্রতিদিন।

৪। যশবন্তপুর স্টেশন থেকে গোয়া যাওয়ার ট্রেন ছাড়ে। গোয়ার কোলভায় আমরা যে হোটেলে ছিলাম সেটা অপেক্ষাকৃত সস্তা। আমরা ছিলাম সুখসাগর হোটেলে। ওদের নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে। www.sukhsagargoa.com

৫। গোয়ায় জিনিসপত্রের দাম বিভিন্ন জায়গায় ভিন্নরকম। দরদাম করে কেনা উচিত। খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।